সেঞ্চুরি! তিন অঙ্কের এক জাদুকরী অর্জন। আরাধনার ধন বলেই তা চরম আরাধ্য।
সাধনার ফসল বলেই পরম প্রার্থিত। একজন ব্যাটসম্যানের জন্য তাই টেস্ট সেঞ্চুরির চেয়ে গৌরবের কী হতে পারে!
আর যদি তা হয় ডাবল সেঞ্চুরি? আনন্দটা দ্বিগুণ না, হয়ে ওঠে শতগুণ। বিশ্বাস না হলে মুশফিকুর রহিমকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
আর যদি তা দেশের ইতিহাসের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি হয়? কিংবা রেকর্ড বইয়ে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করার প্রথম উদাহরণের আঁক? শতগুণ নয়, এবার আনন্দ-উল্লাস-গর্ব-মহিমা হয়ে যায় হাজারগুণ। বিশ্বাস হচ্ছে না? সেই মুশফিককেই আবার জিজ্ঞেস করুন না! বাংলাদেশ ক্রিকেটের অর্জনের আলোয় রাঙা এ কীর্তিগুলো তো তাঁরই!
গাঁথুনিটা গড়া ছিল আগের দিন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অপরাজিত সেঞ্চুরির সেই ভিত্তির ওপর মুশফিক কাল গড়লেন ডাবল সেঞ্চুরির বিশাল ইমারত। যেন রানের তাজমহল; সৌন্দর্যের পেলব দ্যুতি ছড়ায় যা। যেন ক্রিকেটের সবুজে ব্যক্তিগত সামর্থ্যের আইফেল টাওয়ার; যা স্পর্ধা দেখায় আকাশ স্পর্শের। বাংলাদেশের ক্রিকেট রূপকথায় অক্ষয় কালিতে লেখা হয়ে যায় তাই নতুন এক অধ্যায়।
অক্ষর আর সংখ্যার খেলায় লাল-নীল দীপাবলির কী অলৌকিক উৎসব সেখানে!
ডাবল সেঞ্চুরির ব্যাপারটি ধরুন। বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের যে ওই সুমেরু শিখর জয় করা সম্ভব, প্রথম তা করে দেখান মুশফিকই। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গল টেস্টে। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে পরবর্তীতে সে চূড়ায় সাফল্যের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ান তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান। কিন্তু ‘প্রথম’ তো চিরকালই থাকবেন মুশফিক। ঠিক তেমনি দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করা বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবেও জ্বলজ্বল করবে তাঁর নাম। পরপরই উইকেটরক্ষণে নেমে আরো এক রেকর্ডে খোদাই তা। দেশের সীমানা পেরিয়ে যা আন্তর্জাতিক, বর্তমান সময় পেরিয়ে যা চিরকালীন। ক্রিকেট ইতিহাসে উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান হিসেবে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি তো মুশফিক ছাড়া নেই কারো। এমনকি ১১ দ্বিশতক করা কুমার সাঙ্গাকারারও না। ওই একাদশের একটিতেই শুধু গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি।
টেস্ট সেঞ্চুরি সংখ্যায় কিন্তু বাংলাদেশে সবার ওপরের নন মুশফিক। ৮ সেঞ্চুরি নিয়ে সে সিংহাসন তামিম ইকবালের। চলতি টেস্টে সপ্তম সেঞ্চুরি করে ওই বাঁহাতির ঘাড়ে নিঃশ্বাস আরেক বাঁহাতি মমিনুল হকের। তালিকায় এরপর সমান ছয় সেঞ্চুরিতে মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে পরশুই ব্র্যাকেটবন্দি মুশফিক। কিন্তু ডাবল সেঞ্চুরিতে কাল ছাড়িয়ে যান সব স্বদেশিকে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০০ রানে দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংসটিও নামের পাশে ছিল। তামিম, সাকিবের ডাবল সেঞ্চুরিতে রিলে রেসের ব্যাটনের মতো তা হয়ে যায় হাতবদল। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনা টেস্টে তামিমের ২০৬ মুশফিককে ঠেলে দেয় দ্বিতীয়তে; গত বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে সাকিবের ২১৭ রান তৃতীয়তে। কাল অপরাজিত ২১৯ রানে আবার রাজত্ব পুনরুদ্ধার মুশফিকের।
খুব সহজ কি ছিল কাজটি? যতই সেঞ্চুরি করুন, পরদিন ক্রিজে গিয়ে আবার তো শুরু করতে হয় শূন্য থেকে। ১১১ রানে অপরাজিত মুশফিককেও কাল তাই প্রথম দিকে কম ঘাম ঝরাতে হয়নি। প্রথম ঘণ্টায় যোগ করতে পারেন না চার রানের বেশি। কিন্তু ধৈর্য হারিয়ে তেড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে আফসোসের আগুনে পোড়ার উপলক্ষ তৈরি করেন না। ব্যাটের কানায় লাগে বল, প্রতিজ্ঞা আরো শাণিত হয় মুশফিকের। ওভারের পর ওভার রানের দেখা পান না, চোয়াল হয়ে ওঠে আরো দৃঢ়। এই মুশফিক তাই হারেন কিভাবে!
হারেন না বলেই মাহমুদ উল্লাহ ও আরিফুল হকের আউটেও বিচলিত হন না। স্ল্যাশ করে মারা বাউন্ডারিতে পৌঁছে যান দেড় শ রানের মাইলফলকে। সিকান্দার রাজাকে পর পর দুই বলে চার-ছক্কায় দেখান বেপরোয়া বীরত্বের ঝলক। আবার ডাবল সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় পৌঁছে ঋষির মগ্নতায় স্থির হয়ে থাকেন নির্বিকার। ১৯৯ রানে দাঁড়িয়ে মেডেন ওভার দিয়েও অস্থির হন না মুশফিক। তাইতো পরের ওভারে রাজার বলে এক রান নিয়ে দ্বিশতকের ক্লাবে ঢুকে পড়তে পারেন গৌরব নিয়ে। এরপর দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংসে একে একে ছাড়িয়ে যান নিজেকে, তামিমকে, সাকিবকে। রাজদণ্ড হাতে মুকুটটা আবার করে নেন নিজের। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহ ইনিংস ঘোষণা করতে করতে আরো কিছু রেকর্ডে মুশফিক উঠে যান সবার ওপরে। ৪২১ বল খেলায় যেমন ২০১৩ সালে গলে আশরাফুলের ১৯০ রানের ইনিংসের ৪১৭ বল টপকে হয়ে যান দেশের দীর্ঘতম ইনিংসের মালিক। বলের হিসাবের মতো সময়ের হিসাবেও। সেখানে পেছনে ফেলেন অভিষেক টেস্টে ভারতের আমিনুল ইসলামের ১৪৫ রানের ইনিংসের ৫৩৫ মিনিটকে। মুশফিকের এ ইনিংসটি ৫৮৯ মিনিটের।
এই অবিস্মরণীয় কীর্তির পর ইনিংস ঘোষণা হতেই দৌড়ে ড্রেসিংরুমের দিকে ছোটেন কীর্তিমান। আকাশের উজ্জ্বল সূর্যটাও তখন যেন ছুটছিল ছোটখাটো গড়নের এই বিশাল হৃদয় ক্রিকেটারের পিছু পিছু। যেন কুর্নিশ করতে চায় আপাদমস্তক ‘ক্রিকেটার’ মুশফিককে। ক্যারিয়ারজুড়ে তাঁর অবিরাম চেষ্টা, তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, তাঁর অদম্য অধ্যবসায়কে।
শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে কাল মেরেকেটে হাজার তিনেক দর্শক। এর অর্ধেকেরও বেশি স্কুলছাত্র। সময়ের নিয়মে ওরা একদিন বড় হবে, বুড়ো হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, সন্তান থেকে নাতি-নাতনির কাছে তখন গল্প করবেন গর্ব নিয়ে—‘ছিলাম। অর্জনের আলোয় রাঙা মুশফিকুর রহিমের ওই ডাবল সেঞ্চুরির দিনে আমিও ছিলাম গ্যালারিতে!’
গল্পের সময় কল্পনার ডানায় উড়ে শেরেবাংলার আকাশে আঁকবেন রংধনুর ছবি। যার সাত রঙে খুঁজে পাবেন মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিংয়ের বীরত্ব। লালিত্য। পৌরুষ। প্রতিজ্ঞাও।