একটি দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য তার ওপর শত শত পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের দরকার হয় না। এমনকি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণেরও প্রয়োজন পড়ে না। যদি তা হতো, তবে ১৯৪৫ সালে যখন হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটোকে পারমাণবিক বোমার আঘাতে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল, এরপর এ নামে আর কোনো জনপদ এ পৃথিবীতে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু আজকের প্রাণচঞ্চল ঝকঝকে হিরোশিমা আর নাগাসাকি দেখে কে বলবে এ দুটো জনপদে সেদিন পোড়ামাটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না? সুতরাং শুধু ভৌত অবকাঠামো ধ্বংস করে বা লাশের দীর্ঘ মিছিল বানিয়ে একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। তবে একটি বর্ধিষ্ণু জাতিকে খুব সহজেই ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে, বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়া যায় যদি ছোট্ট করে তার মধ্যে শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি করে দেয়া যায় কিংবা বিজাতীয় চর্চার মাধ্যমে শিক্ষা-সংস্কৃৃতিকে নৈতিকতার পথ থেকে ছিটকে দেয়া যায়, তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করার জন্য চলার পথকে কিছুটা দুর্গম করে দেয়া যায়।
কেউ হয়তো বলবেন, এটা কী ধরনের অস্বাভাবিক কথা? অস্বাভাবিক নয়। একবার ভেবে দেখুন, যে যুক্তরাষ্ট্র আজ এমআইটি, প্রিন্সটন, জন হপকিন্স, ক্যালটেক, হার্ভার্ড ও কার্নেগি মেলনের মতো বিশ্বখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরা এবং যে দেশের জ্ঞানী বা বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সবাইকে টেক্কা দিয়ে প্রায় সব ক’টি নোবেল পুরস্কার বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছেন, যে দেশে পড়ালেখা করতে যাওয়ার জন্য পৃথিবীর আনাচে-কানাচের ছেলেমেয়েরা চেষ্টা-তদবিরে ঘুম হারাম করে ফেলছে- এক শ’ বছর পর সে দেশের শিক্ষার অবস্থা কেমন হবে? আপনি হয়তো বলবেন, ভাবাভাবির কী আছে? ভালোই তো চলছে। কিন্তু এখানেই আমি একটু ভিন্নমত পোষণ করছি। সে দেশের ন্যাটিভদের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে যে, সব অভিবাসী এসে আমাদের সব কর্মক্ষেত্র দখল করে ফেলছে। সুতরাং তাদের তাড়াতে পারলেই সব কর্মক্ষেত্র আমাদের হয়ে যাবে। আমরাই গ্রেট, আমরাই সব চালাব। কিন্তু একবারও ভাবছে না, ক্ষেত্রগুলো চালাতে হলে নিজেদেরকে উপযুক্ত করে তৈরি করতে হয়। শিক্ষার আলোতে আলোকিত হতে হয়। অভিবাসীরা তো এমনি এমনি সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নেয়নি। নিজেদের শিক্ষিত করেই উপযুক্ততা অর্জন করেছে।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভালোভাবেই চলছে এবং চলবে। কিন্তু তা চলবে সেই অভিবাসীদের নিয়েই। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়- আমেরিকানরা আজ বেশ হতাশাগ্রস্ত এবং অবসাদ তাদের পেয়ে বসেছে। মন তাদের কিছুটা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। অনেক রাজ্যেই আজ মারিজুয়ানা চাষ ও সেবন আইন করে বৈধ করে দেয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে মাদকাসক্তি তাদের গ্রাস করে ফেলছে।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অশান্তি থেকে মনকে একটু দূরে রাখার জন্য অনেক রাজ্য সরকার এ সহজ অথচ আত্মঘাতী পথে মানুষকে উৎসাহিত করছে। আর এতে সবার অলক্ষে মানুষ শিক্ষা থেকে ধীরে ধীরে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছে। ঠিক উল্টো চিত্র দেখছি গণচীনে। ৪০ বছর আগের গণচীন আর আজকের গণচীন সম্পূর্ণ এপিঠ আর ওপিঠ। অতি নীরবে নিঃশব্দে তারা তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে নিজের মতো করে সাজিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যে, আর ৫০ বছর পর পৃথিবীর জাতিগোষ্ঠীর তালিকায় চীনাদের অবস্থান কত দূরত্বে শীর্ষস্থানে থাকবে, সেটিই দেখার বিষয়। আগে যেমন ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য আমেরিকা- ইউরোপ যেত, আজকাল ধীরে ধীরে অনেকেই চীনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যাচ্ছে এবং এ সংখ্যা আমি যতদূর জানি দিনে দিনে বেশ বাড়ছে।
এতসব কথার পর কেউ হয়তো ভাবছেন, আমি আমেরিকা ও চীনের শিক্ষা সম্পর্কে কথা বলতে বসেছি। না, মোটেই তা নয়। আমার আজকের প্রেক্ষাপট অবশ্যই আমার প্রিয় দেশ বাংলাদেশ।
অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসে আমাদের অর্জন কম নয়। এ অল্প সময়ে জাতি হিসেবে আমরা অনেক কিছুই পেয়েছি। বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে মুখের ভাষার জন্য আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করেছি। দীর্ঘ রক্তরঞ্জিত পথ বেয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনে সবুজের বুকে বসিয়েছি। গণতন্ত্রের জন্য রাজপথ কাঁপিয়েছি। তেল-কয়লা-মোহর ছাড়াও শুধু বাহুবলে উচ্চ জিডিপির দ্বারপ্রান্তে কড়া নাড়ছি। কিন্তু এসব অর্জন টেকসই করার জন্য সবচেয়ে দরকার যে আলোকিত শিক্ষাভুবন, তার পথে কতটুকু এগোতে পেরেছি? এ প্রশ্ন শুধু আমার একার নয়, কান পাতলে শোনা যাবে- অসংখ্য মানুষের ও প্রায় সবার। জীবনের ৭০টি বসন্ত পেরিয়ে প্রায় চার যুগের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসিক্ত হয়ে আজ যখন এ পাতাটি উল্টাতে যাই, তখন মনটা একটু খারাপ হয়েই যায়। নিজ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার, শিক্ষার আঙ্গিক ও মাত্রিক কোনো দিক সম্পর্কেই লিখতে গিয়ে আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারছি না। কিছু সমস্যা বেশ ভাবিয়ে তুলছে। কিন্তু আমাদের সমস্যাটা ঠিক আমেরিকার মতো নয়। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের দেশের সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়। তাই কোনো ধরনের অবসাদগ্রস্ততা আমাদের নেই। পড়ালেখার প্রতি কোনো অনাগ্রহের সমস্যার মুখোমুখিও আমরা নই। এ মুহূর্তে সাড়ে ষোলো কোটি জনসংখ্যার মধ্যে সাড়ে চার কোটিই হলো শিক্ষার্থী, যা ব্যাপক শিক্ষাপ্রীতিরই লক্ষণ। আমাদের সমস্যা অন্যত্র। শিক্ষা জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিকল্পনাহীনতা, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা এবং আন্তরিকতা ও উদ্যোগের অভাব আমাদের জন্য পথে পথে বাধার সৃষ্টি করছে। পরিমাণগত দিকে যথেষ্ট এগোলেও স্বাধীনতার ৪৬ বছরে শিক্ষার কাক্সিক্ষত গুণগত মান অর্জনের পথে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি। রক্তঝরা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি জাতির ক্ষেত্রে এটি হওয়া উচিত ছিল না।
শিক্ষার উন্নয়নে পরিকল্পনা এবং সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কনসেপ্ট একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। প্রথমেই যদি বলি- একটি কার্যকর ও টেকসই শিক্ষা কাঠামো বিনির্মাণে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির থাকা প্রয়োজন। বিভিন্ন স্তরে আমরা কী পড়াব, কেন পড়াব, কিভাবে পড়াব তা নির্ণয়ের জন্যই একটি অতীব কার্যকর কারিকুলাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রথম এবং মূল কাজ। সামাজিক ও জাতীয় চাহিদা নিরূপণ করেই এটি করতে হয়। কিন্তু আজকাল দেখি, অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যবস্তুতে হঠাৎ করে বিভিন্ন জিনিস ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এটি অনেকটা চাহিদা অগ্রাহ্য করে সমন্বয়হীন অন্তর্ভুক্তি বলেই মনে হয়। দাবি উঠল তো কখনো এইচআইভি এইডস কখনো ইভটিজিং, কখনো জঙ্গিবাদ ইত্যাদি ঢুকিয়ে দেয়া হয়। যেমন এ মুহূর্তে কেউ কেউ দাবি করছেন রোহিঙ্গা ইস্যু ঢুকাতে। হয়তো দাবির মুখে এটিও কোনো-না-কোনো শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। এভাবে হওয়া উচিত নয়। এটি শিক্ষা কাঠামোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
কারিকুলাম হবে জাতীয় ও সামাজিক চাহিদানির্ভর ও সুসমন্বিত। জীবন চলার পথে সমস্যা সমাধানে পারঙ্গম, ব্যবস্থাপনায় দক্ষ একজন সৃজনশীল সৎ ও নিষ্ঠাবান নাগরিক গড়ে তোলাই হলো কারিকুলামের মূল উদ্দেশ্য। এমন একজন মানুষ তৈরি করতে হবে, যিনি নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করতে পারেন। আবার পরিবার ও সমাজেরও কাজে লাগেন। জাতীয় জীবনে কিছু ভূমিকা রাখতে পারেন এবং প্রয়োজনে এ গ্লোবের জন্য কিছু করারও দক্ষতা অর্জিত হয়। কিন্তু আমাদের উদ্যোগে এর ঘাটতি বেশ প্রকট। আমি দু-একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। যেমন উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর বর্তমান রসায়ন পাঠ্যক্রমে মাখন ও ঘি প্রস্তুতি, স্নো-পাউডার-ক্রিম-লিপস্টিক-মেহেদি প্রস্তুতির মতো অনেক অসংলগ্ন বিষয়বস্তু রয়েছে। এগুলো অপ্রয়োজনীয়, উদ্দেশ্যহীন ও সৃজনশীলতাবিরোধী। আর একটি বড় সমস্যা হলো পাঠ্যপুস্তকে বিরক্তিকর পুনরুক্তি। একই জিনিস পরপর কয়েকটি শ্রেণীর বইতে অন্তর্ভুক্ত থাকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে। একটু সময় নিয়ে সমন্বয় করতে পারলে এ সমস্যা থাকার কথা নয়। আমরা শিক্ষার্থীদের সব জিনিস একত্রে শিখিয়ে দিতে চাই। কেন? দক্ষতা অর্জনে সহায়ক বিষয়বস্তু সাজিয়ে বরং অ্যাকটিভিটি ও সমস্যা সমাধানের সময় ও সুযোগ দিয়ে পাঠ্যক্রম সাজালে শিক্ষার্থীরা নির্ভার হয়ে কাজ করতে পারে। অ্যাকটিভিটি এমনভাবে ডিজাইন করা উচিত যেন এক ঘণ্টার একটি অ্যাকটিভিটি (সমস্যা সমাধানমূলক) করলে ২০ পৃষ্ঠার কনটেন্ট পড়ার সমান কাজ করে। ফলে শিক্ষার্থী উপভোগও করবে, আলোকিতও হবে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক কমানোর জন্য বইয়ের আকার ছোট হওয়া খুবই জরুরি।
একটি ভালো খবর হলো, বহু প্রচেষ্টার পর আমরা ১৭০ বছরের পুরনো একটি অকার্যকর পরীক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তে নতুন সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন করতে পেরেছি। ২০০২ সালে পরিকল্পনা নিয়ে আট বছর পর ২০১০ সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নের মাধ্যমে আমরা এ পদ্ধতি চালু করতে পেরেছি। কিন্তু প্রায়ই পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে নানা নেতিবাচক সংবাদ দেখা যায়। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরির ব্যাপারে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো- বিভিন্ন প্রকল্পে গত এক দশকে প্রায় তিন লক্ষাধিক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষককে বিভিন্ন মেয়াদে এ বিষয়ে প্রচুর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এরপরও বিভিন্ন জেলায় মাস্টার ট্রেনারদের একটি পুল তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এর পরের দায়িত্বটুকু সম্ভবত শিক্ষকদের। পেশা ও সিস্টেমের প্রতি ভালোবাসা থাকলে এত দিনে নিজেরাই সব সমস্যা দূর করে ফেলতেন। আন্তরিক উদ্যোগ থাকলে বিভিন্ন পরীক্ষা, বইয়ের অনুশীলনীসহ নানা উৎসের উদ্দীপক ও প্রশ্নকাঠামো দেখে শিক্ষকেরা যথেষ্ট পরিমাণে স্বপ্রশিক্ষিত হয়ে যাওয়ার কথা। এরপরও কথা হলো নতুন একটি পদ্ধতি এবং একটু সময় লাগতেই পারে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে আজ সৃজনশীল পরীক্ষাপদ্ধতিই চলছে। সুতরাং এর কোনো বিকল্প নেই।
পরীক্ষাপদ্ধতিতে সংস্কার আনতে পারলেও আমরা এর আগের কাজটুকু অর্থাৎ শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। এখনো মান্ধাতার আমল থেকে চলে আসা সেই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে পড়ানোর পদ্ধতিই চলছে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরক্তি সৃষ্টি হয়, প্রায়ই ক্লাসে অমনোযোগী থাকে। আসলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষকে প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য করতে না পারলে চলবে না। নিজেদের অংশগ্রহণের ফলে শিক্ষার্থীদের দক্ষতাও বাড়ে। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শুধু পরিচালনা ও সহায়তার ভূমিকায় থাকবেন। কেবল এভাবেই একটি শিক্ষার্থীবান্ধব ও কার্যকর শিখনব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। এসবের জন্য প্রয়োজন একটি সুসমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যকর করার গোছানো উদ্যোগ।
আমাদের আরো একটি সমস্যা হলো- শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে জাতীয় অপচয়। দৃষ্টির অন্তরালে ও সামনে অনেক ক্ষেত্রেই তা ঘটছে। যেমন কারিকুলাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য আমরা মাঝে মধ্যে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার তহবিল নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করি। সুদ-আসলে এসব ঋণসহায়তা আমাদের পরিশোধ করতে হয়। অথচ এ তহবিলের বিরাট অঙ্কের অর্থ অপচয় হয় নানাভাবে। যেমন- শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা কতটুকু শিক্ষার্থীরা পায় পত্রিকার পাতাতেই এর অনেক খবর পাওয়া যায়। আবার অনেক বিদ্যালয়েই সঠিক ভৌত অবকাঠামো বা উপযুক্ত সংরক্ষণব্যবস্থা নেই। অথচ প্রকল্পের আওতায় কোটি কোটি টাকার কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। সেগুলো যে সংরক্ষণের অভাবে ইতোমধ্যেই খরচের খাতায় চলে গেছে এবং কোনো কাজ না করেই অপারেটররা বেতনভাতা ভোগ করছেন, সেসব খবর প্রায় সময়ই পত্রিকায় দেখা যায়। অপচয় ঘটে কেনাকাটাতেও। তার খবরও বের হয় গণমাধ্যমেই। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে পরিশোধিত এ তহবিলের অর্থ ব্যয় করে কর্তাব্যক্তিরা অনেক সময় শিক্ষাসফরের নামে বিদেশ ভ্রমণে যান। আর বড় বড় সেমিনার করেন কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে। এগুলো করা ও প্রশ্রয় দেয়া এ গরিব জাতির দু’মুঠো ভাতে অন্যায়ভাবে ভাগ বসানোরই শামিল। আর এত ব্যয়-অপব্যয় ও অপচয়সহ যে বিপুল অঙ্কের তহবিল আমরা দাতা সংস্থার কাছ থেকে সংগ্রহ করি, তার বিনিময়ে আমাদের অর্জন খুব সুখকর নয়। তাই যে কাজ প্রকল্পব্যয়ে করা হয় তা রুটিন কাজের অংশ হিসেবে আমাদের জাতীয় বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি, নায়েম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, এইচএসটিটিআই প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষজ্ঞদের দিয়েও পরিকল্পিত উপায়ে করা যায়। শুধু প্রয়োজন মাঝে মধ্যে তাদের কিছু প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানো। তবে প্রয়োজনে পরামর্শক হিসেবে স্বল্পমেয়াদে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া যায়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের সাথে ব্যক্তিপর্যায়ে যোগাযোগ এনসিটিবিই করতে পারে।
শিক্ষার অগ্রগতির পেছনে যে বড় প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা কাজ করছে তা শুধু নয়, স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিপর্যায়ের বাধাও রয়েছে অনেক। পত্রিকায় প্রায়ই খবর বের হয়- দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিআইএ’র পরিদর্শন টিমের প্রতিবেদন অনুযায়ী কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে। আবার যে ডিআইএ এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করছে তার আর্থিক অস্বচ্ছতার খবরেরও কমতি নেই পত্রিকার পাতায়। হয়তো এসব কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অবকাঠামোগত, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি বা খেলাধুলার কাক্সিক্ষত উন্নয়নের মান অর্জিত হচ্ছে না।
এক সময় এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষ করে স্কুলপর্যায়ে চমৎকার পরিদর্শন (স্কুল ইন্সপেকশন) ব্যবস্থা ছিল। মাঠপর্যায়ে বিদ্যালয় শিক্ষকদের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি, তাদের পদায়ন ও শিখন-শেখানোর গুণগত মান সংরক্ষণ বিষয়ে দারুণ কার্যকর মনিটরিং হতো। কখন কিভাবে এসব উঠে গেল জানি না। কেউ হয়তো বলবেন কেন? ডিআইএ তো আছে। ডিআইএ’র কথা যত কম বলা যায় আমার মনে হয় ততই ভালো। তবে এটুকু বুঝি- একটি শক্ত বিদ্যালয় পরিদর্শন ব্যবস্থা বজায় রাখা খুবই জরুরি।
শি
ক্ষকদের কোচিং সম্পর্কে ব্যাপক অভিযোগ। ক্লাস না নিয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। এটি অনৈতিক। এসব ঠেকাতে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি, নীতিমালা আরোপসহ বহু পদক্ষেপই নিচ্ছেন। অথচ পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে এসবে তেমন কাজই হচ্ছে না। আসলে এ ধরনের কাজ চৌকিদারি-নজরদারি করে বন্ধ করা যায় না। এসব করা প্রয়োজন প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে। কারিকুলাম ও শিখনপদ্ধতিই এমনভাবে করতে হবে যেন কোচিং বা নোটবইয়ের কোনো কার্যকরিতাই না থাকে। তাহলে আপনা-আপনিই এসব বন্ধ হয়ে যাবে।
হয়তো প্রশ্ন উঠবে কিভাবে? কারিকুলাম, সিলেবাস তথা পাঠ্যবস্তু কমিয়ে দিন। পাঠ্যবইয়ে পুনরুক্তি বন্ধের ব্যবস্থা নিন, অন্তত স্কুলপর্যায়ে কঠিন গাণিতিক প্রতিপাদন বাদ দিতে হবে, মুখস্থ করতে হয় এমন কোনো দীর্ঘ বর্ণনামূূলক বিষয়বস্তু থাকবে না, অতি সহজ ভাষায় ছোট ছোট ধারণা দিতে হবে, যা শিক্ষার্থী নিজেই পড়ে বুঝবে। পরীক্ষার প্রশ্ন এমন হতে হবে, যে তার উত্তর বইটি পড়লেই দেয়া যায়। এর জন্য অন্য কোনো বই অর্থাৎ নোট বা গাইডবইয়ের প্রয়োজনই হবে না। চিত্র আর ছোট উদাহরণ বা হিসাব বা নিদর্শন থাকবে যা তাকে বিষয়বস্তু স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্যে করে। বিজ্ঞানের জন্য ছোট অ্যাকটিভিটি থাকবে, যা ল্যাবের বাইরে যেকোনো স্থানে করা যায়। শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশের জন্য সহায়ক কার্যক্রম থাকবে। অবসর-বিনোদনের সময়ও দিতে হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের সময়ও দিতে চাই না। এই যে দেখুন। এসএসসি পাস করে এইচএসসিতে ভর্তি হলে ক্লাস শুরু হয় জুলাই মাসে। আর পরের বছর নভেম্বরে টেস্ট পরীক্ষা। সময় কতটুকু পেল? এক বছর চার মাস। অথচ আমরা কাগজ-কলমে বলি দুই বছরের এইচএসসি কোর্স। যদি এইচএসসি পরীক্ষা শুরু পর্যন্তও (১ এপ্রিল) সময় ধরি তা হলেও এক বছর আট মাস সময় পায়। বিষয়গুলো বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক।
লেখক : অধ্যাপক, রসায়ন ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড