গত বছর আগস্টে মিয়ানমার যখন তাদের রোহিঙ্গা নাগরিকদের জাতিগত নিধনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখনই আমরা কিছু দুর্মুখ সে বিষয়ে সরকারকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এর সম্ভাব্য পরিণতি কী দাঁড়াতে পারে, আমরা তারও আভাস দিয়েছিলাম। কিন্তু কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত আনাড়ি এই সরকার সে বিষয়ে কর্ণপাত করেনি। আমাদের সুপারিশ ছিল, এ ব্যাপারটা নিয়ে অবিলম্বে জাতিসঙ্ঘ, ওআইসি, বৃহৎশক্তি ও মুসলিম দেশগুলোর সাথে আলোচনা করে একটি বিশ্বপ্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হোক। সরকার সে কথায়ও কোনো কর্ণপাত করেনি, বরং রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের বর্বরতা দেখে আমরা আগে থেকেই তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছি।
মিয়ানমার বারবার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখেছি। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কিছুই করতে পারিনি। আর এ রকম নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের পর আত্মতৃপ্তির জন্য বলেছি, ‘মিয়ানমার আমাদের অনেক উসকানি দিয়েছিল; কিন্তু তাদের সে উসকানিতে আমরা সাড়া দেইনি।’ মিয়ানমার যদি আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে থাকে, তবে তাদের বিমানগুলোকে আমরা গুলি করে ভূপাতিত করলাম না কেন? আমরা যদি তা করতে পারতাম, তাহলে মিয়ানমারের দুর্বৃত্তরা বুঝতে পারত, ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’। তারা দ্বিতীয় পা ফেলতে সতর্ক হতো। ১২ লাখ উদ্বাস্তু নিয়ে আমাদের এভাবে খাবি খেতে হতো না।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
আমরা অনেক দিন ধরে সরকারের মুখ থেকে শুনে আসছিলাম যে, ‘বিশ্বব্যাপী শুধু আমাদের বন্ধু আর বন্ধু।’ কিন্তু এই বিপদের দিনে কেউ আমাদের ধরা দেয়নি। ভারত-চীন পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন দেশ হলেও এই ইস্যুতে তারা উভয়েই দাঁড়িয়েছে মিয়ানমারের গণহত্যাকারীদের পাশে। রাশিয়াও তাই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সরকার নানাভাবে আগে থেকেই ক্ষেপিয়ে রেখেছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের বিপুল বিনিয়োগের ইসলামী ব্যাংক দখল করে সম্পর্কের কফিনে আরো একটি পেরেক মেরে দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের ভিক্ষাপাত্রে কিছু মুদ্রা ছুড়ে দিয়ে শান্ত হয়ে গেছে। এখন সব কিছু সুনসান।
জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেক কথা বলেছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু তাতে বারবারই ভেটো দিয়েছে ‘বাংলাদেশের পরম বন্ধু’ চীন ও রাশিয়া। ভারত ডুগডুগি বাজিয়েছে। শেষে সরকার বলেছে, ‘আমরা দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যার সমাধান করে নেব।’ কিন্তু সে প্রচেষ্টায় কদলী প্রদর্শন করেছে মিয়ানমার।
ভারতকে কাছা খুলে সব কিছু উজাড় করে দেয়ার সময়ই আমরা কেউ কেউ সরকারকে সতর্ক করেছিলাম, হাতে যেন দু-একটা ‘মুরগা’ থাকে। কিন্তু না; আমাদের দরকষাকষি করার জন্য হাতে কোনো মুরগা নেই। এই সরকার বাংলাদেশকে এমনই এতিম করে ফেলেছে। মিয়ানমারের কাছেও আমরা খুবই অসহায়, কিছুই করার নেই। ১২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, এখনো অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তারা বাংলাদেশে ঢুকছেই। কিন্তু আমরা বসে বসে কেবল আঙুল চুষছি কেন? এর আগে মিয়ানমার যখন রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিতে শুরু করল, তখনই সাবেক বিডিআর প্রধান অব: মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান বলেছিলেন, দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবে আমাদের উচিত অবিলম্বে কমপক্ষে দুই লাখ রোহিঙ্গা তরুণকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখাইনে পাঠিয়ে দেয়া। তাহলেও একটা দরকষাকষির ব্যবস্থা হতো। এখনো যে তা করা অসম্ভব, তা নয়। কিন্তু সে রকম কোনো উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না।
এর মাঝেই নতুন সঙ্কট সৃষ্টি করেছে ভারতের আসামের বিজেপি সরকার। গত ১ জানুয়ারি আসাম সরকার নাগরিকদের একটি জাতীয় রেজিস্টারের খসড়া প্রকাশ করেছে। তাতে তারা দেখিয়েছে, আসামের তিন কোটি ২৯ লাখ লোকের মধ্যে এক কোটি ৯০ লাখই বাঙালি। তারা এক কোটি ৪০ লাখ লোককে নাগরিকের খাতা থেকে বাদ দিয়েছে। আর এই নাগরিকদের বহিষ্কারের জন্য তারা ৬০ হাজার আধা সামরিক বাহিনী নিয়োগ করেছে। এর ফলে আসামের মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই মুসলমানরা আসামে প্রায় ১০০ বছর ধরে বসবাস করে আসছেন। আসামের বিজেপি সরকার আরও বলেছে, আসামে যে ২০ লাখ মুসলমান রয়েছে, তারা গেছে বাংলাদেশ থেকে। এরা যদি নিজেদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করতে চায়, তাহলে দেখাতে হবে যে, তারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকেই আসামে বসবাস করছে। অন্যথায় এদের সবাইকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হবে।’
কায়দাটা একেবারেই মিয়ানমারের মতো। প্রমাণ করো, তুমি মিয়ানমারের নাগরিক। তারপর ফেরত নেয়ার প্রশ্ন। অথচ ১৯৮২ সাল থেকে মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছে। আসামের বিজেপি সরকার একই কৌশল গ্রহণ করেছে। ২০১৭ সালে আসাম বিজেপি ঘোষণা করেছিল, সেখান থেকে শুধু মুসলমানদেরই বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়া হবে; কিন্তু হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা দলিত শ্রেণীর লোকদের সুরক্ষা দেয়া হবে। তা তারা বাংলাদেশ থেকে গেলেও।
এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিপুলসংখ্যক লোককে বিজেপি বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে আটক রেখেছে। কোনো পরিবারের যদি একজনও তার নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে না পারে, তবে তাকে ডিটেনশন সেন্টারে আটক রাখা হবে এবং এক সময় বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হবে। বিজেপি সরকার যে তালিকা তৈরি করেছে, এর মধ্যে রয়েছেন লোকসভা ও বিধানসভার অনেক নির্বাচিত সদস্য। এর বিহিত কী হবে, সে সম্পর্কে বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার কিছুই বলছে না। এ দিকে পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি সরকার বেশ জোরেশোরে বলে যাচ্ছেন, ‘আসামের বিজেপি সরকার যদি বাঙালি হটাও’ অভিযান শুরু করে, তাহলে তার সরকার এটা কিছুতেই মেনে নেবে না। এই ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, সারা ভারতে আগুন জ্বলবে।’ বিধানসভায় মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি এ ইস্যু উত্থাপন করলে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, কাউকে আসাম থেকে বিতাড়িত করা হবে না।
কিন্তু বিজেপি সরকারের কথায় বিশ্বাস রাখার কোনো কারণ নেই। মোদি সরকার এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে যত ধরনের কথা দিয়েছে, তার কোনো কথাই শেষ পর্যন্ত রাখেনি। বরং সেসব কথার বরখেলাপ করার জন্য নানা ধরনের ইতর কৌশল অবলম্বন করেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। বাংলাদেশ তো ভারতকে তার চাওয়া মতো, সাধ্যের অতিরিক্ত নিজে থেকে দিয়ে বসেছে। কিন্তু মোদি সরকার কেবলই দিয়েছে ধোঁকা, তারা কোনো কথাই রাখেনি। তিস্তার পানিবণ্টনের মুলা সামনে ঝুলিয়ে রেখে রেলপথ নৌপথ সড়কপথ ট্রানজিট করিডোর বন্দর সব কিছুর ওপর ভারত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু তিস্তার পানি পাওয়া যায়নি। যুক্তি হিসেবে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তার সরকার পানি দিতে তৈরি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি সরকার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা না হলে দেয়া যেত।’ এর চেয়ে হাস্যকর ছেলেভোলানো যুক্তি আর কিছু হতে পারে না। পানিবণ্টন চুক্তি যদি হতো, তবে সে চুক্তি হতো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের সাথে নয়। তাহলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে মমতা ব্যানার্জির কি হাত আছে? আসলে কোনো হাত নেই। ভারত বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দেবে না, এটাই আসল ব্যাপার।
এখন আসামে বসবাসকারী মুসলমানদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার যে ঘোষণা সেখানকার বিজেপি সরকার দিয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সে ব্যাপারে আশ্বস্ত করার শত চেষ্টা করলেও আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। কারণ আসামের বিজেপি সরকার যদি সত্যি সত্যিই সেখানকার প্রায় দুই কোটি মুসলমানকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় বা দিতে শুরু করে, তখন কেন্দ্রের মোদি সরকার বলবে, এটা তো রাজ্য সরকারের ব্যাপার, এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।’ তখন কী করবে বাংলাদেশ? এখানেও বাংলাদেশের হাতে কোনো ‘মুরগা’ নেই। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের স্রোত ঠেকাতে তবুও যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল। সেখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে রোহিঙ্গা গেরিলা তৈরি করে মিয়ানমারকে নাস্তানাবুদ করে ন্যায্যতার টেবিলে বসানো সম্ভব ছিল; কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে সরকার কী করবে? পাকিস্তান আমল থেকে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এখানকার সরকার সে রকম মুরগা হাতে নিয়েই ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ উল্টো দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের হাতে কোনো ‘মুরগা’ নেই। সুতরাং নতুন করে মিয়ানমারে যা সম্ভব, আসামে বা ভারতের সাথে তা একই কারণে অসম্ভব।
এই যে ‘কাছা খোলার কূটনীতি’, এটি বাংলাদেশে চরম সর্বনাশ ডেকে এনেছে। বাংলাদেশ এখন ভারতের কাছে ব্যবহৃত টিস্যু পেপার ছাড়া কিছু নয়। আর এত বড় হুমকি যে আসাম বিজেপি সরকার দিচ্ছে, তবুও সরকার মিয়ানমার কেসের মতোই নীরবে কিল খেয়ে কিল হজম করে যাচ্ছে। আসাম সরকারের এ ঘোষণার পর শেখ হাসিনার সরকার কোনো পর্যায়েই কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। অর্থাৎ মিয়ানমারের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল, এখনও তাই ঘটছে : ‘দেখি, শালা বাঙাল কা করে’। কিন্তু বাংলাদেশ ইতোমধ্যে যে মহাবিপর্যয়ে পড়েছে, এই প্রক্রিয়া শুরু হলে তা শতগুণে বিস্তৃত হবে। কেন বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কঠোর ভাষায় আসাম সরকারের এই উদ্যোগের প্রতিবাদ জানাল না? কেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে আমাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা জানালেন না? কেন নাগরিকদের চরম অন্ধকারে রাখা হলো? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে যতই ‘ফাল পাড়ি’ না কেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের সাথে খাদ্য ভাগাভাগি করে খাবো’, কিন্তু এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি, রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য বিরাট সঙ্কট সৃষ্টি করেছে।
আমরা যেন রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ায় মিয়ানমারের একেবারে পা ধরতে গেলাম। এক দিকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা আসছে, অপর দিকে আমাদের খাদ্যমন্ত্রী খাদ্য কিনতে সস্ত্রীক মিয়ানমারে গিয়ে হাজির হলেন। বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক অব্যাহত রেখেই নাকি এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাহলে এখন কাঁদছেন কেন? সম্ভব নয়। একইভাবে সম্ভব নয় আসাম যদি সত্যি সত্যিই সেখানকার বাঙালিদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে শুরু করে। সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের সামাজিক স্থিতি, অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়তে পারে। তার ফলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা দেখা দেবে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com