প্রায় অর্ধশত বছর পর সৌরশক্তি প্রযুক্তিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। পেরভস্কাইটস নামক এক যৌগের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের সৌর প্যানেল তৈরি করছেন বিজ্ঞানীরা। নতুন এই সৌর প্যানেলের মডেল বর্তমান মডেলের চেয়ে দ্বিগুণ কার্যক্ষম হবে এবং সম্পূর্ণ ভবন মুড়ে দেওয়ার মতো হবে যথেষ্ট নমনীয়।
১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির বেল ল্যাবে দৈনন্দিন ব্যবহার্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের জন্য শক্তি উৎপাদনে সক্ষম প্রথম সৌরকোষ তৈরি করা হয়। সে সময় সিলিকনের তৈরি সৌর প্যানেল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, এবং সূর্যরশ্মির মাত্র ৬ শতাংশ বিদ্যুতে রূপান্তরে সক্ষম ছিল।
এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে সৌর প্যানেলের দাম অনেক কমে এসেছে। বর্তমান যুগের সৌর প্যানেল সূর্যরশ্মির ২২ শতাংশ বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরে সক্ষম। পেরভস্কাইটসের তৈরি সৌর প্যানেল অধিক মাত্রায় শক্তি উৎপাদন সক্ষম এবং এর মাধ্যমে সিলিকনের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপিত হতে পারে।
অক্সফোর্ড পিভির গবেষকরা ২০১৮ সালে সৌর প্যানেলে সিলিকনের ওপর পেরভস্কাইটসের আবরণী ব্যবহার করে ২৮ শতাংশ শক্তি উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, পরবর্তীকালে ৪০ শতাংশেরও বেশি সক্ষমতা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন এই সৌর কোষের মাধ্যমে কম প্যানেল ব্যবহার করে বেশি শক্তি উৎপাদন সম্ভব হবে। এর ফলে সৌর প্যানেল বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা, শ্রম ও সরঞ্জাম কম লাগবে এবং দামেও সাশ্রয়ী হবে।
গবেষণার ফাঁকে অক্সফোর্ড পিভির হেনরি স্নাইথ [বাঁয়ে] ও ক্রিস্টোফার কেস। ছবি: সিএনএন
ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং অক্সফোর্ড পিভির সহ-প্রতিষ্ঠাতা হেনরি স্নাইথ সিএনএনকে জানান, 'আমরা যদি নতুন প্রজন্মের শক্তি উৎপাদন প্রযুক্তিতে ফটোভল্টাইক বা পিভি প্যানেলের ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই, তবে দাম সাশ্রয়ী করার জন্য কাজ করতে হবে। এর একটি উপায় হলো, শক্তি উৎপাদনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি। পেরভস্কাইটস এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।'
গবেষণার ফাঁকে অক্সফোর্ড পিভির হেনরি স্নাইথ [বাঁয়ে] ও ক্রিস্টোফার কেস। ছবি: সিএনএন
পেরভস্কাইটস কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ছায়াযুক্ত এবং মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশে, এমনকি ঘরের ভেতরও সিলিকনের চেয়ে ভালোভাবে কাজ করে।
অক্সফোর্ড পিভি জানায়, পেরভস্কাইটস ভবিষ্যতে সিলিকনের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করবে।
'টেমিং দ্য সান: ইনোভেশন টু হারনেস সোলার এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার দ্য প্ল্যানেট' বইয়ের লেখক ও শক্তি বিশেষজ্ঞ বরুণ শিবরাম বলেন, 'সামনের দিনগুলোতে সৌর প্যানেলে পেরভস্কাইটস আবরণীর ব্যবহার শক্তি উৎপাদনের কার্যক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করবে, সৌর প্যানেলের ব্যবহৃত ওজন কমিয়ে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদির স্থানান্তর ব্যয় হ্রাস করবে।'
তিনি জানান, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে ভবিষ্যতে পেরভস্কাইটস স্প্রে করে অথবা নমনীয় পৃষ্ঠে মুড়িয়ে ব্যবহার করাও সম্ভব হবে। এছাড়াও অর্ধস্বচ্ছ পেরভস্কাইটস আবরণী কোনো ভবনের সম্পূর্ণ পৃষ্ঠে মুড়ে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
অক্সফোর্ড পিভি বর্তমানে জার্মানির ব্র্যান্ডেনবার্গে কারখানায় ব্যবহারের উপযোগী সৌর কোষ নির্মাণের কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, সৌর কোষের মাধ্যমে নির্মিত এই নতুন প্রযুক্তি সৌর প্যানেল ক্রয় ও স্থাপনের কাজে এক হাজার ডলায় ব্যয় হ্রাস করবে।
পেরভস্কাইটসের নমনীয়তা পরখ করছেন সাউল টেকনোলজির টিম। ছবি: সাউল টেকনোলজি
ভারসাভা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সাউল টেকনোলজিও পেরভস্কাইটস নির্ভর সৌর প্যানেল নির্মানের কাজ করছে। এ কাজে ১০ মিলিয়ন ইউরো অর্থায়ন করেছে পোলিশ ফটোভল্টাইক প্রতিষ্ঠান কলাম্বাস এনার্জি। গত মাসে সাউল টেকনোলজির ভারসাভার কারখানায় ইঙ্কজেট প্রিন্টারের মাধ্যমে পেরভস্কাইট সৌর কোষ উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সামনের বছরের শুরুতে সুইডিশ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি স্কানস্কা গ্রুপকে নতুন এই সৌর প্যানেল সরবরাহের চুক্তি করেছে।
স্কানস্কা গ্রুপ জানিয়েছে, তারা প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে প্রিন্টেড সৌর কোষের ব্যবহার শুরু করবে।
সাউল টেকনোলজির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ওলগা মালিনকিয়েউইকজ বলেন, 'নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের সামগ্রিক অবস্থাই বদলে দেবে পেরভস্কাইটস। কারণ, এটি যে কোনো ধরনের আবহাওয়ায়ই ভালো কাজ করে। একে যেকোনো প্রয়োজনে পরিমার্জন করে ব্যবহার করা সম্ভব। স্থপতিরাও তাদের কাজের জন্য এটি পছন্দ করবেন।'
সূত্র: সিএনএন