আরবি ‘মেরাজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ- সিঁড়ি, সোপান, ঊর্ধ্বগমন, বাহন, আরোহণ ও উত্থান ইত্যাদি। অন্য অর্থে ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ বা মহামিলনকে মেরাজ বলে, যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিশেষ মুজিজা এবং আল্লাহর কুদরতের মহানিদর্শন। এক লাখ মতান্তরে দু’লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রাসূলের মধ্যে একমাত্র বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে মিরাজের এ অনন্য মর্যাদায় সম্মানিত করা হয়; যাতে তিনি আল্লাহতায়ালার ঊর্ধ্বজগতের নিদর্শনাবলি নিজ চোখে দেখতে পারেন এবং উম্মতের কাছে বিস্তারিত বলতে পারেন।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘পবিত্র মহামহিম তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে এক রাতে তাঁর অসীম কুদরতে কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য মাসজিদুল হারাম থেকে নিয়ে যান বরকতময় পরিবেশপূর্ণ মসজিদুল আকসায়। নিশ্চয় তিনি সব শোনেন, সব দেখেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল, ১৭ : ১)
মেরাজের রাসূল (সা.)-এর বয়স পঞ্চাশ বছর। নবুয়তের দশম বছর চলছে। ওই বছরের রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে মিরাজের আশ্চর্যময় ঘটনা ঘটে। ওই রাতে হুজুর (সা.) কাবা শরিফের চত্বর হাতিমে কাবায় অথবা কোনো কোনো গবেষকের মতে, উম্মে হানির ঘরে শুয়ে ছিলেন। অল্প সময় হল তিনি ঘুমিয়েছেন। এমন সময় ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) এসে হজরতকে ঘুম থেকে জাগালেন, অজু করালেন, ওপেন হার্ট সার্জারি করলেন এবং ‘বোরাক’নামক বিশেষ রকেটে চড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে বায়তুল মোকাদ্দাস পৌঁছালেন।
সেখানে নবীজি (সা.) ‘ইমামুল মুরসালিন’ হিসেবে সব নবী-রাসূলকে নিয়ে দু’রাকাত নফল নামাজের ইমামতি করলেন। এরপর তিনি আবার বোরাকে চড়ে আকাশজগৎ ভ্রমণ করে সেখান থেকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’নামক বিশেষ স্থানে পৌঁছেন। এখানে এসে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) থেমে গেলেন এবং নবী করিম (সা.) একাকী আরও দ্রুতগতিসম্পন্ন মহাকাশযান ‘রফরফে’ চড়ে ‘বায়তুল মামুরে’ চলে যান।
এরপর নবী করিম (সা.) দিদারে এলাহি লাভ করেন। এখানে তিনি পরম প্রেমময় প্রভুর সঙ্গে একান্ত আলাপে তন্ময় থাকেন। আশেক ও মাশুকের মধ্যে সংলাপ ও কথোপকথন হল। আল্লাহতায়ালা তাকে পুরো সৃষ্টিজগতের বিশেষ রহস্য বুঝিয়ে দিলেন এবং জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করালেন, যাতে এ সম্পর্কে কথা বলতে তার মনে কোনো সন্দেহ না জাগে। সবশেষে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের বিধান নিয়ে আবার ঐশীবাহনে আরোহণ করে মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
আল্লাহতায়ালা এক বিশেষ উদ্দেশ্যে অর্থাৎ তাঁর মহান কুদরত, অলৌকিক নিদর্শন, নবুয়তের সপক্ষে এক বিরাট আলামত, জ্ঞানীদের জন্য উপদেশ, মুমিনদের জন্য জ্বলন্ত প্রমাণ, হেদায়েত, নিয়ামত ও রহমত, ঊর্ধ্বলোক সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানার্জন, সৃষ্টিজগতের রহস্য উন্মোচন, সরাসরি বেহেশত-দোজখ দেখা, পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের সঙ্গে পারস্পরিক সাক্ষাৎ ও পরিচিতি, সুবিশাল নভোমণ্ডল ভ্রমণ, মহাকাশ, আরশ, কুরসি, লওহ, কলম প্রভৃতি সামনাসামনি দেখিয়ে দেয়ার জন্য তার প্রিয় হাবিবকে নিজের একান্ত সান্নিধ্যে তুলে নিয়েছিলেন; যাতে তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে ইসলামের মর্মবাণী প্রচার করতে পারেন। বেশির ভাগ আলেমের মতে, মেরাজ কোনো স্বপ্ন ছিল না, মহান আল্লাহর কুদরতে এটি বাস্তবেই হয়েছিল।
মিরাজের রাত অতি বরকতময় একটি রাত। এ রাতে নফল ইবাদত-বন্দেগি করা অলি-বুজুর্গদের স্বভাব। সুফিরা এ মহামিলনের রাতকে নিজেদের মুক্তির জন্য অসিলা মনে করতেন। আজ বিশ্বব্যাপী যে মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চলছে, এ সময় এমন একটি সোনালি রাত নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। এ রাতে আমরা খোদার দরবারে কেঁদে তওবা করব। নবীজির মেরাজকে অসিলা করে বিশ্ববাসীর মুক্তি ও শেফার জন্য দোয়া করব। আমরা আশা করি, আল্লাহতায়ালা আমাদের দোয়া শুনবেন। আমাদের হৃদয়ের কান্না প্রভুর দরবারে কবুল হবে। বিশ্ববাসী করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাবে। হে আল্লাহ! বিশ্ববাসীকে আপনি ক্ষমা করে দয়ার চাদরে ঢেকে নিন। মহামারী করোনা থেকে আপনি আমাদের নাজাত দিন। আমিন।
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী : মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব