নিখোঁজ থাকা অবস্থায় টিনসেডের মেঝেতে ঘুমাতেন। খাবার দেয়া হতো দরজার নিচ দিয়ে। কথাগুলো বলছেন, নিখোঁজের দীর্ঘ দুই মাস ১০ দিন পর মুক্ত জীবনে ফিরে আসা সাংবাদিক উৎপল দাস।
উৎপল জানান, অপহরণকারীরা তাকে একটি টিনশেড ঘরে রেখেছিল। সেখানে কোনও খাট বা চৌকি ছিল না। ফলে মেঝেতেই ঘুমাতেই হতো। ঘরের দরজা বন্ধ থাকতো। তাই দরজার নিচ দিয়ে খাবার দিয়ে যেতো।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টায় আধুরিয়া গ্রামের শাহজালাল পেট্রল পাম্পের সামনে কে বা কারা তাকে (উৎপল দাস) নামিয়ে দিয়ে যায়।
উৎপল দাস বলেন, ‘বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার কথা ছিল এখান থেকে। তবে গাড়ির টিকিট পাইনি। এরপর রূপগঞ্জ পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে আসে। পুলিশ পরিদর্শক শহীদুল ইসলাম গিয়ে আমাকে সিএনজি স্টেশন থেকে নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে আমার সাংবাদিক ভাইয়েরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমাকে চোঁখ বাধা অবস্থায় তিন-চার ঘণ্টা একটি গাড়িতে করে ঘোরানো শেষে এখানে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু আমি জানি না। আমাকে যখন এখান (আধুরিয়া) নামিয়ে দেওয়া হয় তখন তারা আমার চোখ খুলে দিয়ে বলেছে, আমরা যখন গাড়ি টান দেবো তখন তুই চোখ খুলবি।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে একটি টিনশেড নরমাল ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। তিন বেলা নরমাল খাবার দেওয়া হতো। সেখানে চৌকি বা খাট ছিল না। ফ্লোরের মধ্যে থাকতে হয়েছিল। ওই ঘরে এটাচ বাথরুম ছিল। সেখানে গোসল করতাম। আমার ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। তারা দরজার নিচ দিয়ে খাবার দিয়ে যেতো।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথম দিকে কিছু চড়-থাপ্পড় মারা হয়েছে। তারা আমাকে বলতো, তোর অনেক টাকা। তুই টাকা দে।’
উৎপল দাস বলেন, ‘আমাকে ধানমন্ডি স্টার কাবাবের সামনে থেকে দুপুরের দিকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পেছন থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার চোখ বাঁধা ছিল। কাউকে দেখতে পাইনি।’
উৎপল আরো বলেন, ‘যারা আমাকে ধরে নিয়েছিল, তারা আমার মোবাইল নিয়ে যায়। এরপর কি হয়েছে আমি জানি না। তারা কি করেছে জানি না। তারা আমার কাছে টাকা চাইতো। আমার কাছে মোবাইল ছিল না। আজ আমাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে করে এখানে নিয়ে আসে। চোখ খুলে দেওয়ার পর আমি বুঝতে পারি এটা ভুলতা, নারায়ণগঞ্জ।’
বোন বিনিতা রাণী বলেন, দুই মাস ১০ দিন প্রতীক্ষায় থাকার পর আজ রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমরা খবর পাই উৎপলকে পাওয়া গেছে। তখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করি।
বিনিতা রাণী আরো বলেন, উৎপল জানিয়েছে তাকে অপহরণের পর তার কাছে টাকা চাওয়া হয়েছে। কেউ কি টাকা পয়সা চেয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে? এক মাস আগে আমার কাছে ফোন আসে। বলা হয়, তাকে টাঙ্গাইল পাওয়া গেছে। ওই ব্যক্তি নিজেকে এসআই রিপন তালুকদার বলে পরিচয় দেয়। সে তখন বলে, ‘উৎপলকে পাওয়া গেছে মুমূর্ষু অবস্থায়। তার চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছি। আমি আর খরচ করতে পারছি না। আপনি টাকা পাঠান।’ ওই ব্যক্তি আমাকে সময় দেন টাকা পাঠানোর জন্য। এভাবে আমাকে বার বার টাকা পাঠানোর জন্য বলেছে। আমি সময় নিতে নিতে তার সঙ্গে কথা বা যোগাযোগ করতে পারিনি। এক ঘণ্টা পর আমরা জানতে পারি, এটা মিথ্যা একটা খবর। এরপর থেকে কোনও খোঁজ পাইনি। আমরা তাকে পাওয়ার জন্য র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি। পরিবারের পক্ষ থেকে যখন ২৩ তারিখ থানায় জিডি করা হয় তখন ওর মুঠোফোন নম্বর থেকে ফোন আসে। এক লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরদিন আবার এক লাখ টাকা দেওয়ার জন্য ফোন আসে। তখন আমার বাবা বলেন, ‘আমি টাকা দেব, কোথায় দেব? কিভাবে দেব?’ তিনি উৎপলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এরপর আর ওই নম্বর থেকে কোনো ফোন আসেনি। ওরা কারা তারও কোন পরিচয় দেয়নি। যারা তাকে তুলে নিয়ে গেছে তারা বলেছে, উৎপলকে ফিরে পেতে হলে এক লাখ টাকা দিতে হবে। আমার বাবা টাকা দিতে চাইলেও তারা উৎপলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়নি।
রূপগঞ্জ থানার ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনর্চাজ পরিদর্শক শহীদুল ইসলাম বলেন, আমি মহাসড়ক এলাকায় তদারকির দায়িত্বে ছিলাম। এ সময় এসপি সাহেব ফোন করে বলেন, ‘সাংবাদিকরা ফোন করছেন। উৎপল দাস নামের নিখোঁজ কোনও সাংবাদিকের তথ্য জানো?’ আমি তখন স্যারকে বলি, আমি এই মুহূর্তে কোনও তথ্য জানি না। তিনি খোঁজ নিতে বললেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সাংবাদিকরা আমাকে ফোন করতে শুরু করেন। আমি খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম। জানতে পারলাম, শাহ্জালাল ফিলিং স্টেশনে উৎপল দাস রয়েছেন। পৌঁনে ১২টার দিকে আমি সেখানে গেলে তিনি (উৎপল) আমাকে দেখে পুলিশের লোক মনে করেন। জিজ্ঞেস করি আপনি কী উৎপল দা? তখন তিনি হ্যাঁ বলে জবাব দেন। পরে তাকে বলি, আমি পুলিশ পরিদর্শক। আমার সঙ্গে চলুন। তাকে পাম্পের ভেতরে নিয়ে যাই। এ সময় তার সঙ্গে এসপি সাহেব একাধিকবার কথা বলেন। আমাকে দেখে তিনি স্বস্তি পেয়েছেন।
রাত ২টা ৪০ মিনিট ভুলতা পুলিশ ফাঁড়িতে আসেন উৎপলের বাবা-মা বোন, বোন জামাই, ছোট ভাগিনা। এ সময় মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কান্নায় মুষড়ে পড়েন বাবা ও বোন ভাগিনারা। দুই মাস ১০ দিন পর সন্তানকে ফেরত পেয়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় সেখানে। উপস্থিত সাংবাদিকরাও কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যান মা-ছেলের এমন আবেগাপ্লুত দৃশ্য দেখে। রাত ৩টার দিকে উৎপলকে পুলিশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে। পরিবারে সদস্যরা একটি সাদা হায়েস গাড়িতে করে উৎপলকে নিয়ে নরসিংদীর রায়পুর থানার রাধানগর গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ সময় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শহীদুল আমলের নেতৃত্বে একদল পুলিশ নারায়ণগঞ্জের সীমানা পার করে নরসিদী পুলিশের প্রহরায় দিয়ে আসে।