বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল, ১৪৪৫ | ০১:১২ পূর্বাহ্ন (GMT)
ব্রেকিং নিউজ :
X
শিরোনাম :
  • নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে আ.লীগ: কাদের
  • ইসি নয়, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে হার্ডলাইনে যাবে বিএনপি


মঙ্গলবার, ২১ মে ২০১৯ ১০:১০:০৪ অপরাহ্ন Zoom In Zoom Out No icon

বন্ডের ৬৭ মাফিয়ার কাছে জিম্মি দেশীয় শিল্প

বন্ডেড ওয়্যার হাউসের অবৈধ চোরাচালানে জড়িত ৬৭ মাফিয়ার কাছে জিম্মি দেশীয় শিল্প খাত। শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধার অপব্যবহার করে কাপড়, কাগজ, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করছে চোরাকারবারিরা। অবৈধ প্রক্রিয়ায় তারা প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার পাশাপাশি চোরাচালান বাণিজ্যে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠছেন। একই সঙ্গে তারা দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে লাখ লাখ মানুষকে বেকারত্বের কঠিন জাঁতাকলে ফেলে দিয়েছেন। এ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আবুল হোসেনসহ মাফিয়ারা একেকজন এতটাই প্রভাবশালী যে, নানা উদ্যোগ আয়োজন নিয়েও তাদের অপকর্ম থামাতে পারছে না কেউ। বন্ড মাফিয়া হিসেবে চিহ্নিত একেকজন রাঘববোয়ালের ৭/৮/১০টি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলেই বন্ড সুবিধার আওতায় কোটি কোটি টাকার পণ্য খোলা বাজারে বিক্রির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। ৬৭ বন্ড মাফিয়ার বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময় জাল-জালিয়াতি ও বন্ড লুটপাটের অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে, দফায় দফায় অভিযানে তাদের গুদাম ও গাড়ি বহর থেকেই জব্দ করা হয়েছে শত শত কোটি টাকার মালামাল। কিন্তু মামলা সুরাহার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণে মাফিয়াদের এখন পর্যন্ত কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। এসব কারণে রাজস্ব বিভাগের কঠোর নির্দেশনা, ধারাবাহিক অভিযান, মালামাল জব্দ কোনো কিছুই বন্ড মাফিয়াদের কাছে পাত্তা পায় না। জানা গেছে, রাজধানীর ইসলামপুর ও নয়াবাজারে এই মাফিয়া- গডফাদারদের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। হুন্ডির মাধ্যমে তারা অর্থ পাচার করে অবৈধভাবে কাগজ ও কাপড় আনছে। এই মাফিয়াদের কারণে টেক্সটাইল, কাগজ, প্লাস্টিক, দেশীয় বিভিন্ন শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। বন্ডের অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৬৭ জনের কাছে জিম্মি দেশীয় শিল্প খাত। এদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান না করা হলে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক বেকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও পিভিসি কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বন্ডের অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কারা তা জানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। কাস্টমসের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বন্ড সংক্রান্ত অপরাধে সাড়ে চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান নানা সময় অপরাধী হিসেবে জড়িত থাকলেও বার বার একই অপরাধে জড়িয়ে থাকা ৬৭টি প্রতিষ্ঠানকে এ পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে অন্যান্য মামলা ও অভিযানে জব্দ হওয়া পণ্যের সূত্র ধরে মাফিয়াদের সুনির্দিষ্ট করার কার্যক্রম চলছে এখনো। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বন্ডের এই ৬৭টি মাফিয়া দেশীয় শিল্প খাতকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ব্যাংকিং খাত ধ্বংস করছে এবং বিকাশমান দেশীয় শিল্প ধ্বংস করছে। চোরাকারবারিদের এই মাফিয়া গোষ্ঠী দেশ ও জাতির শত্রু। এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা। এসব মাফিয়াকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিটিএমএ সভাপতি বলেন, অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো কার্যত বন্ধ কিন্তু তাদের বন্ড লাইসেন্সগুলো বিভিন্ন পন্থায় কার্যকর রেখে সুবিধা গ্রহণ করছে। আমরা মনে করি, বন্ডেড ওয়্যার হাউস লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চিহ্নিত এবং তাদের মধ্যে কতটি চালু রয়েছে, তা নির্ধারণ করে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ড লাইসেন্স বাতিল করা দরকার। বন্ধ কারখানার বন্ড লাইসেন্স ব্যবহারের অনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ হলে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা পাবে। বন্ড সুবিধার নামে বছরের পর বছর ধরে নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের লুটপাট দুর্বৃত্তপনা অবিলম্বে বন্ধ করে দেশীয় শিল্প রক্ষার জোর দাবি জানিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। তারা চোরাচালানে সম্পৃক্ত মাফিয়াদের আইনের আওতায় আনারও দাবি করেছেন। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বলেন, দেশীয় শিল্প খাত আমাদের বিকাশমান অর্থনীতির প্রাণ। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে দেশীয় শিল্প খাত ধ্বংস হতে পারে না। সবার আগে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশীয় শিল্প রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে বন্ডে শৃঙ্খলা খুবই জরুরি। যারা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চোরাচালান নামক অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব। বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি শাহেদুল ইসলাম হেলাল বলেন, বন্ডের অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার। এখনো বন্ডে যেসব অনিয়ম আছে, সেটা দূর করতে হলে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ও বন্ড কমিশনারেটের আরও বেশি কাজ করার সুযোগ আছে। এটা করতে পারলে চোরাকারবারিদের ধরা সহজ হবে। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ-বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার আড়ালে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এর সঙ্গে বন্ডের অটোমেশনও জরুরি। সরেজমিন দেখা যায়, পুরান ঢাকার নয়াবাজার ও ইসলামপুরে প্রতিদিন গভীর রাতে ট্রাকে ট্রাকে খালাস হয় কাপড়, প্লাস্টিক ও কাগজ জাতীয় বিভিন্ন পণ্য। চোরাকারবারিরা এসব পণ্য বিক্রি করছে কালোবাজারে। রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হওয়া পণ্যের অবৈধ্য বাণিজ্যে ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় শিল্প খাত। এতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, বন্ড সুবিধার পণ্য কালোবাজারে বিক্রি এবং চোরকারবারি ঠেকাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার নির্দেশনার আলোকে সাম্প্রতিক সময়ে ২৯ ঝটিকা অভিযান চালিয়েছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। সংস্থাটি জানিয়েছে, এসব অভিযানে প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার অনিয়ম উদঘাটন করেছে বন্ড কমিশনারেট। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত আমদানি প্রাপ্যতা নির্ধারণ আদেশের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানির পর তা বিক্রি করে দিচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নামধারী চোরাকারবারি। দু-একটি ঘটনা বন্ড কর্মকর্তাদের হাতে ধরা পড়লেও বেশির ভাগ থাকছে আড়ালে। মূলত দুভাবে বন্ডের পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়। প্রথমত অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড লাইসেন্স খুলে পণ্য আমদানির মাধ্যমে। বিগত ২০১৫ সালে ঢাকা বন্ড কমিশনারেট থেকে এ জাতীয় ৪৭৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। দ্বিতীয়ত আমদানি প্রাপ্যতা জালিয়াতি। এ প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কাঁচামাল শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করে। মূলত আমদানি প্রাপ্যতা নির্ধারণ পদ্ধতির দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই এ কাজটি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অনেক প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আদেশ যৎসামান্য থাকলেও শুধু মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী প্রাপ্যতা নির্ধারণ করিয়ে নিচ্ছেন। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করছেন অসাধু কর্মকর্তারা। পরে তা খোলা বাজারে বিক্রি করছেন। প্রসঙ্গত, যেসব রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক ও নির্বাচিত স্থানীয় শিল্প খাতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য তৈরি ও তা রপ্তানি করেন, তাদেরকে সরকার বন্ড সুবিধা দেয়। বিগত ২০০০ সাল থেকে তৈরি পোশাক ও স্থানীয় শিল্প ও কূটনৈতিক বন্ডের আওতায় এই সুবিধা দেওয়া হয়। সরেজমিন দেখা যায়, গত কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন গভীর রাতেই ট্রাকে ট্রাকে কাপড় ও কাগজ জাতীয় পণ্যসামগ্রী বোঝায় ট্রাক খালাস হয় রাজধানীর ইসলামপুর, নয়াবাজার, চকবাজার মোড়, সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে। নিয়মনুযায়ী- পুনঃ রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হওয়া পণ্যসামগ্রী খালাস হওয়ার কথা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়্যার হাউসে। কিন্তু চোরকারবারিতে জড়িত একটি সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী চক্র সে পণ্য বিক্রি করছে কালোবাজারে। এর মধ্যে বটম গ্যালারি, ট্রাউজার ওয়ার্ল্ডসহ ৭টি প্রতিষ্ঠান প্রায় রাতেই কালোবাজারে পণ্য বিক্রি করছে। সম্প্রতি গভীর রাতের এক অভিযানে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য বোঝাই ট্রাক হাতেনাতে আটক করেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ডের কর্মকর্তারা। জানা গেছে, বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার অপব্যবহার ও চুরির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ইপিজেডগুলোর কর্মকর্তারা। আর কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী শুল্ক দিয়ে সামান্য পণ্য আমদানি করে, বাকি পণ্য বন্ড থেকে অপসারিত পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে এক ভ্যাট চালানের রসিদ ব্যবহার করে। এসব অনিয়ম ও চোরাচালান ঠেকাতে সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। ইতিমধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যান শুল্ক গোয়েন্দা, বন্ড কমিশনারেটসহ সব কাস্টমস কমিশনারকে নির্দেশনা দিয়েছেন। সে নির্দেশনার আলোকে সর্বশক্তি দিয়ে অভিযান পরিচালনা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম খতিয়ে দেখছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার এস এম হুমায়ন কবির বলেন, বন্ডের অপব্যবহার রোধে তথাকথিত রপ্তানি খতিয়ে দেখা শুরু হয়েছে। অবৈধ বাজারে সার্বক্ষণিক নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।





আরো খবর