নোয়াখালীর সুবর্ণ চর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের মধ্য বাগ্যার বাসিন্দা সিএনজিচালক সিরাজ মিয়ার ঘরে একদল সন্ত্রাসী প্রবেশ করে তাঁকে ও তাঁর সন্তানদের বেঁধে রেখে স্ত্রীকে (৪২) বাড়ির উঠানে নিয়ে ধর্ষণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার তাঁকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ ঘটনায় থানায় মামলা হলে পুলিশ বাদশা আলম নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে। তবে পুলিশ ওই নারীর নির্যাতিত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও বলেছে, ধর্ষণের বিষয়টি ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়া বলা যাবে না। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী বলেছেন, অপরাধী যে-ই হোক, তাদের আইনের আওতায় আনতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ ঘটনায় একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় মানবাধিকার কমিশন বলেছে, ১ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘ধানের শীষে ভোট দেওয়ায় নোয়াখালীর সুবর্ণ চরে ৩১ ডিসেম্বর চার সন্তানের এক জননীকে দুষ্কৃতকারীরা গণধর্ষণ করেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই নারীর অভিযোগ, নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেওয়ায় তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের চেয়ারম্যান তাত্ক্ষণিকভাবে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন এবং প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানের জন্য কমিশনের পরিচালক (জেলা ও দায়রা জজ) আল-মাহমুদ ফায়জুল কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ’
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘পছন্দের প্রতীকে ভোট দিতে রাজি না হওয়ায় নির্বাচনের দিন রাতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সমর্থক দ্বারা একজন নারীকে গণধর্ষণ ও মারধরের অভিযোগ উঠেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ জানাচ্ছে।
’
সন্ত্রাসীদের মারধরে নিজেও আহত এবং নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিরাজ মিয়া জানান, ভোটের দিন চার সন্তানের জননী তাঁর স্ত্রী পাংখার বাজার ১৪ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে একদল সন্ত্রাসী তাঁর স্ত্রীকে ধানের শীষে ভোট না দিতে বলে। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ধানের শীষেই ভোট দেন। এ কারণে সন্ত্রাসীরা তাঁকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। পরে রাত ১২টায় কয়েকজন লোক তাঁর বাড়িতে গিয়ে পুলিশ পরিচয় দিয়ে দরজা খুলতে বলে। তিনি দরজা খুলে দিলে স্থানীয় সন্ত্রাসী মোশারেফ, সালাউদ্দিন, সোহেল, হেঞ্জু মাঝি, বেচু, সোহেল (২), জসীম, আবু, স্বপন, আনোয়ার, বাদশা আলম, হানিফ, আমির হোসেনসহ ১৫-১৬ জন তাঁকে বেঁধে ফেলে। ওই সময় বাড়িতে থাকা তাঁর তিন সন্তানকেও বেঁধে ফেলে ওই সন্ত্রাসীরা।
সিরাজ মিয়া বলেন, ধানের শীষে ভোট দেওয়ায় সন্ত্রাসীরা গালাগাল করে এবং তাঁর স্ত্রীকে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে জোর করে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। এরপর সবাই মিলে তাঁকে ধর্ষণ ও বেদম মারধর করে। সিরাজ মিয়া জানান, তাঁকে এবং তাঁর ছোট ছেলে-মেয়েকেও মারধর করে সন্ত্রাসীরা। তাঁর স্ত্রী সন্ত্রাসীদের চিনে ফেলায় একপর্যায়ে তারা তাঁর স্ত্রীকে জবাই করার উদ্যোগ নেয়। সন্ত্রাসীদের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করে তিনি জীবন ভিক্ষা চান। এরপর তাঁকে সন্ত্রাসীরা জবাই না করে ধর্ষণের পর বাড়ির উঠানে ফেলে রেখে ভোর ৪টার দিকে চলে যায়।
সিরাজ মিয়া জানান, সকালে প্রতিবেশীদের সহায়তায় স্ত্রীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে গেলে রহুল আমিন মেম্বার ধর্ষণের ঘটনা কাউকে বা সাংবাদিকদের জানালে তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। একপর্যায়ে গ্রামবাসীর সহযোগিতায় তিনি দুপুর ১টার দিকে স্ত্রীকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করান।
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সৈয়দ মহিউদ্দিন আবদুল আজিম জানান, নির্যাতিতাকে সোমবার দুপুর ১টায় জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে তাঁর মেডিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তাঁর শরীরে জখমের চিহ্ন রয়েছে। ধর্ষণের বিষয়টি পরীক্ষা ব্যতীত বলা যাবে না। হাসপাতালে তাঁকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চরজব্বার থানার ওসি নিজাম উদ্দিন জানান, গণধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা শুনেই তিনি ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ ওই বাড়িতে গিয়ে কাউকে পায়নি। তবে তাঁর মেয়ের বক্তব্য নিয়েছে। রাতে সিরাজ মিয়া বাদী হয়ে মোট ৯ জন—সোহেল, হানিফ, স্বপন, চৌধুরী, মোশারেফ, বাদশা আলম, সালাউদ্দিন, বেচু, আবুলকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের একজন বাদশা আলমকে আটক করা হয়েছে। সে মধ্য বাগ্যা গ্রামের আহমদ উল্লাহর ছেলে। অন্যদের আটকের চেষ্টা চলছে।
ওসি নিজাম উদ্দিন রাতে ‘মামলার এজাহারের ভিত্তিতে’ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাদী অভিযোগ করেছেন, পূর্বশত্রুতার জের ধরে তাঁর স্ত্রীর ওপর হামলা হয়েছে। ’
স্থানীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অপরাধী যে-ই হোক, তাদের আইনের আওতায় আনতে থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছি। এ ঘটনায় আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি। শুধু আমার আসনেই নয়, এই জেলায় কখনো এ রকম ঘটনা ঘটলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ’
গত রাতে জেলা পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াস শরীফ জানান, ‘আসামিদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। তারা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। আমরা প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চালাচ্ছি। ’
আসকের তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ ডিসেম্বর রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণ চর উপজেলার চরজুবলী ইউনিয়নের এক গ্রামে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে রেখে একজন নারীকে মারধর ও ধর্ষণ করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই অভিযোগকারীর ভাষ্য মতে, যুবকদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ায় তাঁর ওপর এমন আক্রমণ করা হয়েছে। তিনি আরো অভিযোগ করেছেন যে তাঁর ওপর হামলাকারী যুবকদের একটি দল স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং ভোটের দিন তাদের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার প্রস্তাবে রাজি না হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীকে ভোট দেওয়ায় তাঁর ওপর এভাবে আক্রমণ চালানো হয়েছে।
আসক বলছে, নিজের পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট প্রদানের অধিকার প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার। সেটিকে ভয় দেখিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা, প্রতিশোধপরায়ণতার বশবর্তী হয়ে এমন ঘৃণ্যতম আক্রমণ একটি সভ্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না। আসক দ্রুত ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে অভিযোগটি খতিয়ে দেখার এবং সত্যতা সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে।