বিকেল বেলা। দাঁড়িয়ে আছি কলম্বো বিচে। রোদ পড়ে এসেছে। সামনে নিস্তরঙ্গ সমুদ্র। সৈকতে প্রচুর ছাতা চোখে পড়লো। বেশ বড় বড় ছাতা। যারা বসে আছেন তারা ছাতার আড়ালে নিজেদের রীতিমতো আড়াল করে বসেছেন। কৌতূহল হলো। ভাবলাম ঘটনা কী? এতো চমৎকার বিকেল। সামনে সমুদ্র। দারুণ সুখময় বাতাস। এর মধ্যে কেন ছাতার আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকা? আরও ভালো করে নজর করে দেখলাম প্রতিটি ছাতার আড়ালেই রয়েছেন দুজন। একজন নারী ও অন্যজন পুরুষ। এতক্ষণে রহস্যটা ফাঁস হলো। ওরা প্রেমিক জুটি। সমুদ্র সৈকতে বসে রোমান্টিক আলাপে ব্যস্ত। কিন্তু কেউ যেন তাদের চিনতে না পারে তাই এই ছাতার আড়াল। অবাক হলাম, শ্রীলঙ্কার কলম্বো বিচেও এমন ছাতা ভাড়া পাওয়া যায়! জানলাম, এগুলো স্পেশাল বিচ ছাতা।
পদ্ধতিটা আমার বেশ পছন্দ হলো। কিন্তু হায় আড়াল নেওয়ার মতো প্রেমিক ছিল না। আমি শ্রীলঙ্কা যাই ২০০৬ সালে। ২১৪ সদস্যের এক দলের সঙ্গে। আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের সদস্য হিসেবে আমাদের যাওয়া। ‘উই ক্যান ক্যাম্পেইন’ চলছে তখন দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশে। ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসকে উপলক্ষ করে কলম্বোর বিহারা মহাদেবী পার্কে বিশাল কর্মী সম্মেলন হচ্ছে উইক্যান-এর। বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন থেকে ১১৪ জনের প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক দলও অন্তভূর্ক্ত। সুলতানা কামাল ও এম বি আখতারের নেতৃত্বে এই দলে আছেন ফাওজিয়া খন্দকার ইভা, রেখা সাহাসহ অনেকেই। সাংস্কৃতিক দলে বাপ্পা মজুমদার, তামান্না রহমান ও তার দলের নৃত্যশিল্পীরা, উদীচীখ্যাত মাহমুদ সেলিম, মাহমুদুজ্জামান বাবু, সন্দীপনসহ অনেকেই আছেন। সাংবাদিক বলতে আংগুর নাহার মন্টি আর আমি। এই সফরের কারণেই সেসময়কার অক্সফ্যামকর্মী মৃগাঙ্কশেখর ভট্টাচার্য পার্থর সঙ্গে আলাপ হলো। পরে আমরা নেদারল্যান্ডস সফর করেছি একসঙ্গে। সঙ্গে আরও আছেন শিল্পী রেজাউর রহমান। তার সঙ্গেও পরে আরও কিছু জায়গায় সফর হয়েছে। রেজা ভাইয়ের কথা কেন বললাম বিশেষভাবে সেটা পরে বলবো।
তখন ঢাকা-কলম্বো সরাসরি ফ্লাইট নেই। ঢাকা থেকে ব্যাংকক। সেখানে ছয় ঘণ্টা স্টপ ওভার। তারপর কলম্বো। পনেরো ষোল ঘণ্টার যাত্রাপথ। যাত্রা করলাম ঢাকা থেকে। কলম্বো এয়ারপোর্টে যখন থাই এয়ারওয়েজের যন্ত্রপাখির পা স্পর্শ করলো ভূমি তখন মধ্য রাত পেরিয়ে গেছে। এই সফরে আমাদের সঙ্গে এমন অনেক তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী ছিলেন যারা জীবনে প্রথমবারের মতো শুধু বিমানেই চড়েননি, ঢাকাতেও এসেছেন প্রথম। এত বড় একটি দলে সকলের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হবে এমনটি আশা করা যায় না। আমি আর মন্টি ছিলাম পাশাপাশি। ইভা আপা এবং সুলতানা কামাল আপার সঙ্গেও এই যাত্রায় ভালো আলাপ হয়। তাদের কাছ থেকে অনেক বিষয়ে জানতে পারি। আর আখতার ভাই ছিলেন সকলের জন্য সদাব্যস্ত। তিনি খেয়াল রাখছিলেন কারও সমস্যা হচ্ছে কিনা। অনেকবার করে আমার খোঁজখবর করলেন। ১১৪ জনের প্রত্যেকের সুবিধা অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখা চাট্টিখানি কথা নয়।
শ্রীলঙ্কা পৌঁছানোর পরের গল্প আরেকদিন হবে। আজ বলবো কলম্বো বিচ এবং ওয়াত্তালা সমুদ্র সৈকতের গল্প। শ্রীলঙ্কায় আমরা ছিলাম কলম্বোর উপকণ্ঠে ওয়াত্তালা ওয়াটার রিসোর্টে। দারুণ সুন্দর জায়গা। হোটেলের একেবারে সাথেই সমুদ্র। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলে জানালা খুলতেই চোখ জুড়িয়ে গেল সমুদ্রের রূপে।
দারুণ সুন্দর সৈকত। ওয়াত্তালার বুফে ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা সৈকতের একদম কাছে। সকালবেলা মনোরম বাতাস। ব্রেকফাস্ট করেই গেলাম সমুদ্রের তীরে। বালি আর পাথরে মেশানো তীরভূমি। সেখানে বড় একটা পাথরের উপর বসে দেখছিলাম সাগরের ঢেউ। তীরের একটা অংশ সরু হয়ে করিডরের মতো চলে গেছে সমুদ্রের মাঝখানে অনেক দূর অবধি।
আমরা শ্রীলঙ্কা ছিলাম পাঁচ দিন। যেদিনই সময় হতো সন্ধ্যায় ওয়াত্তালার এই সৈকতে সূর্যাস্ত দেখতাম। বিকেলের দিকটায় সৈকতে বেশ ভিড় জমতো। এখানে ওয়াটার বাইক চালাতো অনেকে। আবার মটর বাইক চালাতো বেলাভূমিতে।
কলম্বো বিচে যাবার সুযোগ হয়েছিল দু’বার। বাঁধানো তীরভূমি রয়েছে এখানে। ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অনেক দীর্ঘ হাঁটাপথ। বিকেলে সমুদ্রের তীরে যেন মেলার ভিড়। বিক্রি হচ্ছে হরেক রকম স্থানীয় খাবার। তারমধ্যে একটা হলো শ্রিম্প-ব্রেড টোস্ট। খেতে মন্দ নয়। শ্রীলঙ্কার অনেক খাবারেই নারিকেল তেলের গন্ধ। প্রথমে একটু অসুবিধা লাগে। তারপর খেতে খারাপ লাগে না। সে দেশে নারিকেল প্রচুর এ কথা তো প্রায় সকলেরই জানা। ছোটবেলা থেকে নারিকেল তেলের বিজ্ঞাপনে ‘কলম্বো থেকে আমদানীকৃত’ কথাটি শুনে আসছি। যা হোক এখানে হলুদ রঙের নারিকেল দেখে অবাক হলাম। জীবনে এতো ডাব, নারিকেল দেখেছি হলুদ নারিকেল কখনও দেখিনি। গাছে দেখেই ইচ্ছা জাগলো, হলুদ নারিকেল খেয়ে দেখতে হবে। বাজারে বিক্রিও হচ্ছে দেখলাম। স্বাদ কিন্তু আমাদের দেশের নারিকেলের মতোই। তবে শ্বাসটা কি মিস্টির চেয়ে একটু নোনতার দিকে? হতে পারে। আবার আমার বোঝার ভুলও হতে পারে।
কলম্বো বিচেও নারিকেল বিক্রি হচ্ছে দেদার। আরও নানা রকম খাবার। সামুদ্রিক খাবারও প্রচুর। কলম্বো বিচে সূর্যাস্ত খুবই সুন্দর। মনে হয় মাঝ সমুদ্রে হঠাৎ টুপ করে ডুব দিল সূয্যিমামা। এখানেও ফটোগ্রাফারের ঘোরাঘুরি দেখলাম। হাতে সূর্য নিয়ে ছবি তুলছেন অনেকে। আমার অবশ্য এ ধরনের ছবি তোলা হয়নি। কারণ আমি তো হনুমানের মতো বীর নই যে, সূর্যকে বাহুর নিচে ধরে রাখতে পারবো।
শ্রীলঙ্কার দিনগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ভারত মহাসাগরের কথা। কি উদার তার রূপ। সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অতি প্রাচীন। সেই চাঁদ সওদাগরের সময় সপ্তডিঙ্গা মধুকর যাত্রা করতো সিংহলে। ‘বাঙালির ছেলে বিজয় সিংহ লংকা করিয়া জয়, সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়’ পড়েছিলাম ছোটবেলায়।