প্যারিস থেকে রাতে রওনা হলাম জুরিখের উদ্দেশ্যে। যাবার কথা ছিল জেনেভা। সেখানে অভিবাসী একজন সংস্কৃতিবান বাঙালি আমার থাকা, খাওয়া ও ঘুরবার দায়িত্ব নিয়ে অপেক্ষাও করছিলেন কিন্তু সময়ের অভাবে এই যাত্রায় যাওয়া হলো না। যে বাসে যাচ্ছি, তাতে তিনজন বাঙালি- প্যারিস প্রবাসী মোয়াজ্জেম হোসেন তারা, কবি শামীম রেজা ও আমি। খুব ভোরের দিকে ফ্রান্স থেকে সুইজারল্যান্ডের সীমান্তে প্রবেশ করলাম। এর একটু আগে থেকে তারা ফেসবুক সরাসরি করছিল, তাতে আমার ও শামীমের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল। ও আমাদের দুজনের কাছে জানতে চাচ্ছে, তিন দিন প্যারিস ভ্রমণ শেষে, জুরিখে প্রবেশ করার পূর্ব মুহূর্তের অভিজ্ঞতা। অনেকক্ষণ চলছিল এই লাইভ। হঠাৎ বাস থেমে গেল দুই দেশের বর্ডারের চেকপোস্টে। আমাদের বাসে উঠল সুইস পুলিশ। আমি ও শামীম পাসপোর্ট ও টিকিট দেখালাম, কিন্তু মোয়াজ্জেম দেখাল একটি কাগজ। সেখানকার আইনজীবী কর্তৃক প্রদত্ত কাগজ, যেটি ফ্রান্সের নাগরিকত্ব প্রমাণ করে। সেই কাগজ দিয়ে পুলিশ তাকে জুরিখে প্রবেশ করার অনুমতি দিলো না। তাকে বাস থেকে নামিয়ে প্যারিসগামী অন্য একটি বাসে উঠিয়ে দিলো। আর আমরা চললাম সুন্দরী জুরিখের দিকে।
পৃথিবীর অন্যতম উন্নত ও ব্যয়বহুল দেশ সুইজারল্যান্ডে প্রবেশ করেই কেমন জানি একটি অন্যরকম শিহরণ হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। বাংলাদেশে থাকতেই শুনেছি, ছোট্ট হলেও এই দেশটি সুন্দর ও উন্নত। এই দেশেরই সেই সুইস ব্যাংক যেখানে বাংলাদেশের লুটেরারা টাকা রাখে, কালো টাকা সংরক্ষণের জন্য সুইস ব্যাংকসমূহের খ্যাতি রয়েছে। জুরিখ-জেনেভার সুইজারল্যান্ডটি কেমন? মনে মনে একবার জানবার চেষ্টা করলাম। এটি ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সৌন্দর্যময় দেশ। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইউরোপের সব দেশকে হার মানায়। পাহাড়, আল্পস পর্বতমালা, প্রশস্ত হ্রদ, লেক, ভ্যালি এবং এ্যালপাইন বনাঞ্চল ঘেরা এই দেশটি যেন উজাড় করা সৌন্দর্যের দেশ। পাশাপাশি এ দেশে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ট্রেন, ট্রাম, বাস ও প্রাইভেট কার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। এমনকি এই দেশের প্রধান প্রধান শহর থেকে ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ সাধন ঘটিয়েছে। তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে জুরিখ, বের্ন, ওলজান শহর থেকে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়ার যে কোনো শহরে পৌঁছানো যায়।
সুইজারল্যান্ড ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বলে একে ইউরোপের হৃৎপিণ্ড বলা হয়। সুইজারল্যান্ডের উত্তরে জার্মানি, দক্ষিণে ইতালি, পূর্বে অস্ট্রিয়া, পশ্চিমে ফ্রান্স, উত্তর-পশ্চিমে লন্ডন, দক্ষিণ-পশ্চিমে স্পেনের বার্সেলোনা শহর অবস্থিত। সুইজারল্যান্ডকে কেন্দ্র করে ইউরোপ ভ্রমণ সহজ হয়। কারণ প্লেনে দেড় ঘণ্টায় জেনেভা থেকে বার্সেলোনা বা লন্ডন পৌঁছানো সম্ভব। আবার জুরিখ থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে জার্মানির শহরগুলোতে বা অস্ট্রিয়ায় পৌঁছানো যায়। লজান থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে ইতালির মিলান শহরে এবং ৪ ঘণ্টায় ফ্রান্সের প্যারিস শহরে পৌঁছানো যায়। সুইজারল্যান্ডের প্রধান শহরগুলো হলো রাজধানী বের্ন, জুরিখ, জেনেভা, লজান, ইন্টারলাকেন, বাসেল, সেন্ট গ্যালেন, সেন্ট মারিজ ইত্যাদি।
বার্ন, জুরিখ, লজান থেকে বিভিন্ন দেশে রেল যোগাযোগ আছে। ৩-৬ ঘণ্টার মধ্যে ফ্রান্সের প্যারিস, জার্মানির হামবুর্গ, মিউনিখ ফ্রাঙ্কফুর্ট, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, ইতালির শহর রো, মিলানে ও ভেনিসে যাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর জুরিখ ও জেনেভা থেকেও দু-এক ঘণ্টার মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজধানী ও প্রধান শহরগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব। সুইসের প্রধান শহরগুলো থেকে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শনীয় স্থানে পরিভ্রমণ করা যায়। তবে জেনেভাসংলগ্ন লজান থেকে ভ্রমণই সবচেয়ে সুবিধার। গ্লোন্ডেন পাস ট্রেনে ভ্রমণ করতে হলে লজান থেকে মনট্রক্স আসতে হয়, কারণ মনট্রক্স থেকে এই ট্রেন ছাড়ে এবং জি স্ট্যাড, জুইসিমেন বটারলোকেন ওষ্ঠ ও লজান প্রভৃতি শহরে যায়। এই দেশের ট্রেন যোগাযোগ খুবই উন্নত, আধুনিক ও আরামদায়ক। দাঁড়িয়ে থাকার কোনো সুযোগই নেই। কয়েক মিনিট অন্তর অন্তর ট্রেন। ট্রেন, বাস ও ট্রামে যাতায়াতের জন্য পঞ্চাশ শতাংশ কনসেশনে সুইস পাস কেটে নিতে হয়। এতে পয়সার সাশ্রয় অনেক। এ ছাড়া জিনিসপত্র কিনতে হলে সস্তার বাজার দোকান মিগ্রোজ, ম্যানর, কুপ এবং সিঅ্যান্ডএ। এগুলোতে সব কিছু পাওয়া যায়। রেলস্টেশনসংলগ্ন সব শহরেই আছে।
শহর-শহরতলির রাস্তাঘাট খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কয়েক হাত অন্তর অন্তর ময়লা, আবর্জনা, কাগজের টুকরো ফেলার ডাস্টবিন ঝুলানো। তবে গৃহস্থালির ময়লা বড় পলিথিন প্যাকেটে রেখে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দেয়া হয়। সুইজারল্যান্ডের চারদিকই মনোরম। প্রতিটি প্রান্ত চোখ জুড়ানো। ভ্রমণের ক্ষেত্রে দর্শনীয় স্থানগুলো বাছাই করাও মুশকিল। দর্শনীয় স্থানগুলো হলো মাউন্ট পিক ও গ্লোসিয়ার, মাউন্ট টিটলিস, জুনজফ্রো, সিলর্থন পিগ্লজ গ্লোবিয়া, ম্যাটার হর্ন গ্লোসিয়ার, গ্লোসিয়ার ৩০০০। এছাড়া রয়েছে লেক জেনেভা, লেক কুন, লেক জুরিখ, লেক নিউ চ্যাটেল। এদিকে রাইন ফলস, চিলন ক্যাসেল, স্নো ফলস উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্যে ভরপুর সারাদেশ। ভ্রমণ যেন শেষ হতে চায় না। সুইজারল্যান্ড উন্নত শিক্ষা ও সংস্কৃতির দেশ। দেশটিতে নেই কোনো সন্ত্রাসী-জঙ্গী বা হানাহানির ঝুট ঝামেলা। দেশের লোকসংখ্যা মাত্র পৌনে এক কোটি। জুরিখ অংশের লোকেরা জার্মান ভাষায় এবং জেনেভা অংশের লোকেরা ফরাসি ভাষায় কথা বলে। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিভুক্ত নয়। এদেশের মানুষের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ৬৭.৮২৩ সুইস ফ্রাংক। এখানে জীবন-যাপন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ঘড়ি, চকলেট ও ট্রেন এই তিনটির জন্য সুইজারল্যান্ড বিখ্যাত। বিশ্বের পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় এই দেশটি সত্যিকার অর্থেই রূপময়। এই রূপে চোখ জুড়াতেই জুরিখে প্রবেশ করেছি।
জুরিখ। সুন্দরী জুরিখ। সুন্দরীর শরীরে যখন স্পর্শ করলাম, তখন মেঘাচ্ছন্ন সকাল। আকাশভরা কুয়াশাময় মেঘে ঢাকা। এমন পরিস্থিতিতে, বাস থেকে নেমেই কেমন একটু ধাক্কা খেলাম। ধাক্কা খেলাম দুটো কারণে। প্রথমত একদমই অচেনা, অজানা পরিবেশ। দ্বিতীয়ত যে গরম নিয়ে প্যারিস থেকে বেরিয়ে ছিলাম, এখানে এসে দেখলাম বেশ ঠাণ্ডা। তাই স্যুটকেস খুলে ব্লেজার গায়ে দিলাম এবং জুরিখ শহর ঘোরার জন্য ট্যুর প্যাকেজটির জন্য টিকিট কিনে নিলাম। চার ঘণ্টা ঘুরবার জন্য বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫ হাজার টাকা দিতে হলো। বাসস্ট্যান্ডেই এই প্যাকেজ নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। টিকিট কেনার সময় তাদের কাছেই জানলাম, পাশেই জুরিখ রেলস্টেশন। তারা বললেন, ট্যুর বাসটি এখানে আসবে বেলা একটায়। সুতরাং প্রায় দুই ঘণ্টা সময় আছে আমাদের হাতে। কি আর করা, হাঁটতে হাঁটতে রেলস্টেশনে গেলাম। পৃথিবীর এই নামকরা স্টেশনটির ধরন অন্যরকম। অনেক অন্ধকারে দূরের কুপি বাতির শিখা যেমন প্রাণ নাচায়, তেমনি এই অচেনা স্টেশনে হঠাৎ একজন বাংলাদেশি যুবক দেখে, মনে আলো জ্বেলে উঠল। হেঁটে হেঁটে তার কাছে গেলাম এবং বাংলায় জিজ্ঞেস করলাম- ভাই আপনার নাম কী? বাড়ি কোথায়? কবে থেকে জুরিখে আছেন?
তিনি জানালেন, তার নাম মিজান, বাড়ি কুমিল্লা, এখানে আছেন প্রায় দশ বছর। তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন একটি ফাস্টফুডের দোকানে। সেখানে পেলাম আরো দুজন বাংলাদেশি যুবককে। মিজানুর রহমান আমাদের আপ্যায়ন করলেন। তারপর বললেন, আপনারা ট্যুর বাসে ঘুরে এসে এখানেই বিকেলে থাকবেন, আমি এসে আপনাদের সঙ্গে দেখা করবো।
ঠিক বেলা একটার সময় আমরা ট্যুর বাসে উঠলাম। আমাদের গাইড ৭০ বছর বয়সী একজন সুইসম্যান। বেশ স্মার্ট। তিনি মাইক্রোফোন হাতে অনর্গল বর্ণনা করে যাচ্ছেন, রূপময় জুরিখের ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি। ছোট্ট জুরিখ শহর। বাসে বসে গাইডের কথা শুনছি আর বাইরে তাকিয়ে দেখছি। আকাশ মেঘলা, কখনো টিপটিপ বৃষ্টি, কখনো বৃষ্টিবিহীন। মনে হলো শহরটি ইউরোপের অন্যান্য শহরের চেয়ে একটু আলাদা। ছোট-বড় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাসহ নানান গুরুত্বপূর্ণ স্থান আমাদের দেখানো হচ্ছে। গাড়ি যেতে যেতে প্রথমেই যেখানে থামল, সেটি জুরিখের পুরনো শহর এলাকা, যে স্থানটিতে প্রায় চারশ বছর আগের রোমানীয় সভ্যতার নানা চিহ্ন ও ঐতিহ্য রয়েছে। পুরনো ভাস্কর্য, মেডিকেল কলেজ, লেখক-শিল্পীদের বাড়ি-ঘর, কারুকাজময় স্থাপনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের দেখাচ্ছে গাইড ভদ্রলোক। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সুন্দরী জুরিখের রূপময় লেক এলাকায়। বিশাল লেক, লেকের দুই পাশে পাহাড় আর পাহাড়ের পাদদেশে সাজানো বাড়ি-ঘর। সব মিলিয়ে ছবির মত দৃশ্য। প্রকৃতির এক অনাবিল আচরণ। তবে বৃষ্টিটা বেরসিক। আমাদের গাড়ি গিয়ে লেকের এক পাশে থামল, সেখানে অনেকগুলো স্পিডবোট বাঁধা। লেকের মাঝখানে ফোয়ারা, যেটি অনিন্দ্য দৃশ্য তৈরি করছে। গাইড জানাল এখানে ইচ্ছে করলে আমরা ফটোসেশন করতে পারি। আমরা তাই-ই করলাম। এরপর আবার বাসে উঠলাম, বাস চলল লেকের পাশ ধরে।
এক পাশে লেক ও অন্য পাশে আবাসিক বাড়ি-ঘর, দারুণ আনন্দ পাচ্ছি। বেশ কয়েক কিলোমিটার এভাবে যেতে যেতে বাস থেমে গেল, গাইড জানাল এবার আমরা লেকের ওপারে যাবো। লেক পার হতে হতে নিসর্গের অন্যরকম অনুভূতিতে মুগ্ধ হলাম। লেক পার হয়ে গাইড আমাদের দেখালেন চকলেট তৈরির কারখানা, তারপর ক্যাবল কারে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন এক উঁচু পাহাড়ে। সেখানে একটি চমৎকার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ওখান থেকে লেক ভিউটা আরো সুন্দর দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ সেখানে থেকে আবার নেমে আমরা লেকের অন্য পাড় ধরে ফিরে যেতে থাকলাম স্টারটিং পয়েন্টের দিকে। হঠাৎ একটি বাড়ির সামনে গাইড গাড়ি থামিয়ে আমাদের বললেন, এটি হচ্ছে নোবেলজয়ী বিখ্যাত জার্মান লেখক টমাস মানের বাড়ি। দেখালেন বাড়ির পাশেই তার কবর। আবারো বাস চলতে থাকল এবং বিকেল পাঁচটার সময় আমাদের নামিয়ে দিলো। বিভিন্ন দেশের প্রায় ২৫জন পর্যটক একত্রে জুরিখ ভ্রমণ শেষ করলাম। বাস থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে গেলাম সেই রেলস্টেশনে। গিয়ে দেখলাম, কুমিল্লার যুবক মিজান আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তার আন্তরিকতা দেখে আমরা দারুণ খুশি হলাম। তিনি সেখানে আমাদের বার্গার ও ড্রিংকস দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক বসে থাকলাম, কারণ শামীম রেজা এখান থেকে চলে যাবে ইতালির ভেনিসে আর আমি জার্মানের ক্যাসেলে। শামীমের বাস সন্ধ্যা সাতটায়। আমারটা রাত এগারোটায়। শামীম বিদায় নিয়ে চলে গেল আর মিজান সাহেব আমাকে নিয়ে গেল তার জুরিখের বাসায়। স্টেশন থেকে তার বাসার দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। প্রথমে ট্রামে ও পরে বাসে করে নিয়ে গেলেন। বাসায় তার স্ত্রী ও এক কন্যা এবং পুত্র সন্তান। দারুণ পরিপাটি বাসা। আমি গোসল করে, খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘণ্টাতিনেক সময় বিশ্রাম করলাম। ভাবলাম, আমার কপালের কথা? হায়রে কপাল, সুইজারল্যান্ডের মতো একটি ধনী রাষ্ট্রে, কোনো পরিচিত বাঙালির সঙ্গে যোগাযোগ না করে এসে, অসহায় পরিস্থিতিতে এক বাঙালি বিনয়ী ভদ্রলোকের দেখা পেয়ে ধন্য হলাম। একেই বলে সৌভাগ্য!
মিজান সাহেবের স্ত্রী ও পুত্র-কন্যারাও এই অচেনা আমাকে পেয়ে দারুণ চেনা হয়ে গেল। একজন দেশের মানুষকে পেয়ে তারা আমাকে চার ঘণ্টা আগলে রাখল আপন আলয়ে। বিভূঁইয়ে তাদের অসাধারণ আদর-যত্ন পেয়ে আমিও আবেগতাড়িত হয়ে পড়লাম। তখন রাত দশটা। বেরুচ্ছি জার্মানিতে যাবার উদ্দেশ্যে, কিন্তু মিজান সাহেবের দুই সন্তান আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। বলছে, আঙ্কেল তুমি যাবে না, আমাদের বাসায়ই থাকো। আমার চোখে জল এসে গড়িয়ে পড়ল। আমি মায়ার বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে এলাম জুরিখের রাস্তায়। বাসস্ট্যান্ডে যেতে একবার ট্রাম বদল করতে হয়। প্রথম ট্রামটি থামল একটি বিশাল বিল্ডিংয়ের পাশে। মিজান সাহেব আমাকে বললেন, শিহাব ভাই এটিই হচ্ছে সুইস ব্যাংক যেখানে বাংলাদেশিসহ বিশ্বের বহু লুটেরাদের কালো টাকা রয়েছে। রাতের নিয়ন আলোয় তৎক্ষণাত কয়েকটি ছবি ও্ঠালাম। ভাবলাম হায় বাতির নিচে অন্ধকার!
পরের ট্রামে উঠে ছুটে চললাম কাঙ্ক্ষিত বাসস্ট্যান্ডের দিকে। ট্রাম থেকে সেই রেলস্টেশনের পাশে নামলাম। উঠলাম জার্মানগামী ফ্লিক্স বাসে। মিজান সাহেব আমাকে উঠিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি চুপি চুপি নেমে গেলেন। তখন সুইস সময় রাত এগারোটা। আমার বাস ছেড়ে দিল। আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মিজান সাহেব আমার চোখের সীমানা থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন আর রাতের জুরিখ ক্রমশ ভেসে উঠছে আমার চোখে। বুড়িগঙ্গা পাড়ের এই আমি সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুইজারল্যান্ড থেকে ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছি আপন গন্তব্যের দিকে।