মাত্র কয়েক বছর আগেও ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের বৈরী সম্পর্ক নিয়ে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই সন্দেহ পোষণ করতেন। আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। এর মধ্যে এক গ্রীষ্মে সৌদি কর্মকর্তারা গোপনে ভিয়েনা, সাইপ্রাস ও রিয়াদে ইসরায়েলি ব্যবসায়ীদের ছোট একটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
ইসরায়েলি ওই ব্যবসায়ীরা এসব বৈঠকে দেশটির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সৌদি আরবের কাছে এনএসও–এর পেগাসাস স্পাইওয়্যার বিক্রি করা। এখন এই স্পাইওয়্যার নিয়েই বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে। ৫০টির বেশি দেশে ইসরায়েলি কোম্পানির এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষের স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হয়েছে।
এসব ব্যক্তির তালিকায় রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, লেখক–গবেষক, এনজিও কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টরাও রয়েছেন। এনএসও গ্রুপের একটি তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত ৫০ হাজার ফোন নম্বর ফাঁস হয়েছে। সেগুলো নিয়ে কয়েক মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে স্মার্টফোনে আড়ি পাতার এই ঘটনা প্রকাশ করেছে ১৭টি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
এখন দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী সরকারকে ফোনে নজরদারির এই প্রযুক্তি সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কেরও উন্নতি ঘটিয়েছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের দমন–নির্যাতনের জন্য মুসলমানদের ক্ষোভের মুখে থাকা ইসরায়েল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গেই সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছে।
২০১৭ সালের জুনে সাইপ্রাসে সৌদি আরবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইসরায়েলি ব্যবসায়ীদের যে বৈঠক হয়, সেখানে উপস্থিত একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের। তাঁর ভাষ্যমতে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার নিয়ে উপস্থাপনা দেখে সৌদি আরবের একজন জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
সেখানে দীর্ঘ আলোচনায় স্পাইওয়্যারের কারিগরি দিক তুলে ধরা হয়। পরে সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তার নতুন আইফোনে দেখানো হয় কীভাবে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ঢুকিয়ে দূর থেকে ফোনের ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটা দেখে ওই কর্মকর্তারা একই সঙ্গে বিস্মিত ও আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই অস্ত্রই তো তাঁদের দরকার।
নিজেদের দেশে তৈরি এই হ্যাকিং টুল সৌদি আরবের কাছে বিক্রির চেষ্টা করতে এনএসও গ্রুপকে অনুমতি দিয়েছিল ইসরায়েল সরকার। গোপনে কয়েক দফা বৈঠকের পর কমপক্ষে সাড়ে ৫ কোটি ডলার দিয়ে স্পাইওয়্যারটি কিনেছিল সৌদি সরকার।
ওই ব্যক্তির ভাষ্যমতে, সে সময় ইসরায়েলে ব্যবসার মধ্য দিয়ে কূটনীতিকে এগিয়ে রাখার পক্ষে জোরালো রাজনৈতিক অবস্থান ছিল। ‘ব্যবসা প্রথম, তারপর কূটনীতি’ নীতি নিয়েছিল তারা। এই নীতির পক্ষে যুক্তি ছিল, যখন তুমি একসঙ্গে কোনো চুক্তি করবে, তখন কূটনীতির অনেক দরজা খুলে যাবে।
এদিকে ইসরায়েলের একদল সাবেক সাইবার গোয়েন্দা কর্মকর্তার হাত ধরে গড়ে উঠেছিল এনএসও গ্রুপ। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল তাদের। কোন কোন দেশকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার দেওয়া যাবে, আর কাদের দেওয়া যাবে না, সেই সিদ্ধান্ত ইসরায়েল সরকারের কাছ থেকেই আসত।
এর প্রমাণ পাওয়া যায় সম্প্রতি প্রকাশিত এনএসও গ্রুপের একটি প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনো দেশের কোনো সংস্থাকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডিফেন্স এক্সপোর্ট কন্ট্রোল এজেন্সি (ডিইসিএ) তাদের মানবাধিকার রেকর্ড খতিয়ে দেখে। তারপরই লাইসেন্স দেওয়া হয়।
গ্রাহক যাচাই–বাছাইয়ের এই প্রক্রিয়াকে এনএসও গ্রুপের মধ্যেও দেখা হয় ‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা’ হিসেবে। এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত একজনের ভাষ্যমতে, কারও কাছে পেগাসাস স্পাইওয়্যার বিক্রির জন্য ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সম্মতি নিতে হয়। সে জন্য ওই দুই দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিষয়টি আগেই জানানো হয়ে থাকে।