সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল, ১৪৪৫ | ০৫:৩১ অপরাহ্ন (GMT)
ব্রেকিং নিউজ :
X
শিরোনাম :
  • নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে আ.লীগ: কাদের
  • ইসি নয়, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে হার্ডলাইনে যাবে বিএনপি


বৃহস্পতিবার, ১৭ জানুয়ারী ২০১৯ ০৩:১৬:২৫ পূর্বাহ্ন Zoom In Zoom Out No icon

শ্রমিক বলেই অবহেলা উদ্ধারে!

জীবিকার তাগিদে পাবনার ভাঙ্গুড়া থেকে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গিয়েছিলেন হতভাগ্য মানুষগুলো। সংসারের অন্য সদস্যদের মুখে দু-মুঠো অন্ন তুলে দিতে করতেন মাটি কাটার কাজ। গত সোমবার গভীর রাত থেকে ওই মানুষগুলোর আর সন্ধান মিলছে না। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার চরঝাপটার কাছে মেঘনা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকারের ধাক্কায় মাটিবোঝাই ট্রলারডুবির ঘটনায় ২০ শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন। সাঁতরে তীরে উঠে এসেছেন ১৪ জন। সোমবার রাত ৩টার দিকে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে ট্রলারে মাটি নিয়ে ৩৪ জন শ্রমিক যাচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বক্তাবলীতে। যে ১৪ জন শ্রমিক তীরে উঠে এসেছেন, মঙ্গলবার ভোরেই তাঁরা চরঝাপটায় স্থানীয় লোকজনকে দুর্ঘটনার কথা জানান। ভাঙ্গুড়ায় স্বজনদের কাছে ফোন করেও দুর্ঘটনার কথা জানান। স্বজনরা ছুটে যায় স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে। তাঁরা ছুটে যান ভাঙ্গুড়া থানা-পুলিশের কাছে। ভাঙ্গুড়া থানার ওসি ফোন করে দুর্ঘটনাটির কথা জানান গজারিয়া থানার ওসিকে। তিনি জানান নৌ পুলিশকে। এত কিছুর পরও শুরু হয় না উদ্ধার অভিযান। বরং গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া হয় প্রশাসন থেকে। মুন্সীগঞ্জ প্রশাসনের উদ্ধার অভিযানে এমন বিলম্বের কারণে জনমনে দেখা দেয় নানা প্রশ্ন। সোমবার রাত ৩টায় ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটলেও ২৯ ঘণ্টা পর গতকাল বুধবার সকাল ৮টায় প্রশাসন শুরু করে উদ্ধার অভিযান। তবে গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত ট্রলারটির সন্ধান মেলেনি। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৭টায় ফের শুরু হবে উদ্ধার অভিযান। মুন্সীগঞ্জ সদরের ইউএনও ফারুক আহম্মেদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার কারণে দুর্ঘটনার স্থান চিহ্নিত করতে সমস্যা হচ্ছিল। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের নিয়ে গতকাল দুর্ঘটনার স্থান এবং দুর্ঘটনায় পড়া ট্রলারটি শনাক্তের চেষ্টা চলেছে। ঘটনাস্থলে মুন্সীগঞ্জের প্রশাসন ছাড়াও পুলিশ, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড, বিআইডাব্লিউটিএ ও ফায়ার সার্ভিস কাজ করছে। গতকাল বিকেল ৫টায় উদ্ধার অভিযান শেষ করা হয়েছে। আজ সকাল ৭টায় ফের উদ্ধার অভিযান শুরু হবে। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের বরাত দিয়ে ইউএনও জানান, কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে ট্রলারে মাটি নিয়ে ৩৪ জন শ্রমিক নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বক্তাবলীর একটি ইটভাটায় যাচ্ছিল। বিপরীত দিক থেকে আসা একটি তেলবাহী ট্যাংকার ট্রলারটিকে ধাক্কা দেয়। এতে ট্রলারটি ডুবে যায়। ট্রলারে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে ১৪ জন সাঁতরে কূলে আসতে পারলেও ট্রলারের কেবিনে ঘুমন্ত ২০ শ্রমিকের ভাগ্যে কী হয়েছে এখনো কেউ তা জানে না। এঁদের মধ্যে ১৭ জনের বাড়ি পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলায় এবং একজনের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। ডুবে যাওয়া ট্রলারটির মালিক বক্তাবলীর জাকির দেওয়ান। ট্রলারডুবির ঘটনায় জাকির দেওয়ান অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন বলে জানা গেছে। ট্রলারের মালিকের পক্ষ থেকে এখনো কেউ দুর্ঘটনাস্থলে আসেনি। মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান জনান, মঙ্গলবার পাবনার ভাঙ্গুড়া থানায় ওসির মাধ্যমে ট্রলারডুবির ঘটনা জানতে পেরে মেঘনায় নৌ পুলিশ দিয়ে সন্ধান চালানো হয়। কিন্তু নৌ পুলিশ এ রকম কোনো ঘটনার তথ্য মেলাতে পারেনি। গতকাল বুধবার সকাল থেকে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। তবে ট্রলার কিংবা শ্রমিকদের হদিস মেলেনি। মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা জানান, ঘটনাস্থলে উদ্ধারকারী জাহাজ তলব করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড ও বিআইডাব্লিউটিএ কাজ করছে। এদিকে নিখোঁজদের স্বজনরা আসতে শুরু করেছে ঘটনাস্থলে। ঘটনাস্থলে গজায়িরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান সাদী জানান, মেঘনা অনেক বড় নদী। তাই শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। পাবনা থেকে নিখোঁজদের ৩০-৩৫ জন স্বজন এসেছে। মেঘনার পারের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নৌ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মাহাবুবুর রহমান, নৌ পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের এসপি হুমায়ুন কবির গতকাল দিনভর মেঘনা নদীতে উদ্ধার অভিযান তদারক করেন। ট্রলারডুবিতে বেঁচে যাওয়া শ্রমিক পাবনার হাবিবুর রহমান ও পরশ কুমার সিং জানান, নদীতে প্রায় এক ঘণ্টা সাঁতার কেটে একটি বালুর জাহাজে উঠে প্রাণে বাঁচেন তারা। বেঁচে যাওয়া আরেক শ্রমিক মামুন আলী জানান, তাঁরা ১৪ জন প্রাণে বেঁচে গেলেও কেবিনের ভেতরে থাকা ২০ জনের কেউই বেরোতে পারেনি। মামুন আরো জানান, তেলের ট্যাংকারটি দেখতে পেয়ে ট্রলারের চালক বিপত্সংকেত বাজান। এ সময় তাঁরা তাড়াহুড়া করে ওপরে উঠে আসার আগেই ট্যাংকারটি ট্রলারকে প্রবল ধাক্কা দেয়। এরপরই ট্রলারের বাইরে থাকা শ্রমিকরা ছিটকে নদীতে পড়ে যায়। আর ডুবে যায় ট্রলারটি। কিন্তু তেলের ট্যাংকারটি তাঁদের উদ্ধারে কোনো ধরনের সাহায্য করেনি। নিখোঁজ ২০ জনের পরিচয় মিলেছে নিখোঁজ ২০ জন হলেন—পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের মুণ্ডুমালা গ্রামের গোলাই প্রামাণিকের ছেলে সোলেমান হোসেন, জব্বার ফকিরের ছেলে আলিফ হোসেন ও মোস্তফা ফকির, গোলবার হোসেনের ছেলে নাজমুল হোসেন, আব্দুল মজিদের ছেলে জাহিদ হোসেন, নূর ইসলামের ছেলে মানিক হোসেন, ছায়দার আলীর ছেলে তুহিন হোসেন, আলতাব হোসেনের ছেলে নাজমুল হোসেন, লয়ান ফকিরের ছেলে রফিকুল ইসলাম, দাসমরিচ গ্রামের মোশারফ হোসেনের ছেলে ওমর আলী ও মান্নাফ আলী, তোজিম মোল্লার ছেলে মোশারফ হোসেন, আয়ান প্রামাণিকের ছেলে ইসমাইল হোসেন, সমাজ আলীর ছেলে রুহুল আমিন, মাদারবাড়িয়া গ্রামের আজগর আলীর ছেলে আজাদ হোসেন, চণ্ডীপুর গ্রামের আমির খান, আব্দুল লতিফের ছেলে হাচেন আলী এবং উল্লাপাড়া উপজেলার গজাইল গ্রামের তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে রহমত আলী, রজব আলীর ছেলে শফিকুল এবং জনৈক সিরাজ মিস্ত্রি। বেঁচে যাওয়া ১৪ জন মামুন আলী, আবদুর রাজ্জাক, উত্ফল, প্রদীপ, শহিদুল, কায়েস, অমূল্য, শাহ আলম, হাবিবুর, সালাম, নজরুল, কালশে, কার্তিক ও মাঝি হাবিব। উদ্ধার অভিযানে মুন্সীগঞ্জ প্রশাসনের উদাসীনতা ডুবে যাওয়া ট্রলারটি সম্পর্কে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানা পুলিশ মঙ্গলবার সকালে অবগত হলেও তারা ট্রলারটি উদ্ধারে তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয় সাংবাদিকরা পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করলেও পুলিশ ট্রলারডুবির ঘটনাটি নিশ্চিত করতে পারেনি। বরং তারা এটিকে গুজব বলে উড়িয়ে দেয়। মঙ্গলবার বিকেলে গজারিয়া থানার ওসি হারুনুর রশীদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা শুনেছি। মেঘনায় ট্রলারটির সন্ধ্যানে নৌ পুলিশ পাঠিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো খবর দিতে পারেনি। ’ ভাঙ্গুড়ায় ১৯ পরিবারে শোকের মাতম পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার খানমরিচ ইউনিয়নের মুণ্ডুমালা, দাসমরিচ, চণ্ডীপুর আর মাদারবাড়ীয়া গ্রামের বাতাস গত দুদিন ধরে ভারী হয়ে উঠেছে। সোমবার গভীর রাত থেকে এসব গ্রামের ১৭ জনের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবারের লোকজন শুনেছে, মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবির ঘটনায় তাঁরা নিখোঁজ হয়েছেন। গতকাল বুধবার বিকেল পর্যন্ত কেউই এই নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি। হতভাগ্য এই মানুষদের স্বজনরা জানায়, জীবিকার প্রয়োজনে তাঁরা সবাই মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে মাটিকাটার কাজ করতেন। নিখোঁজদের মধ্যে মুণ্ডুমালা গ্রামের একই পরিবারের দুই সহোদরসহ ৯ জন, দাসমরিচ গ্রামের একই পরিবারের চারজনসহ মোট পাঁচজন, চণ্ডীপুর গ্রামের দুজন এবং মাদারবাড়ীয়া গ্রামের একজন রয়েছেন। তাঁদের বাইরে আরো দুজন রয়েছেন। তাঁদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার বিভিন্ন গ্রামে। দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে খানমরিচ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুর রহমান তাঁর ছোট ভাই রতন আহমেদকে মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়ায় পাঠান। রতন গতকাল নিখোঁজদের নাম-পরিচয় উল্লেখ করে গজারিয়া উপজেলা প্রশাসনের কাছে একটি তালিকা দেন। হতভাগ্য পরিবারের সদস্যরা জানায়, মঙ্গলবার ভোরে তারা মোবাইল ফোনে জানতে পারে, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া এলাকায় ট্রলারডুবির পর থেকে তাদের পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ রয়েছেন। গতকাল ভাঙ্গুড়া উপজেলার শোকবিহ্বল গ্রামগুলোর বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনার খবর এলাকায় পৌঁছার পর থেকেই নিখোঁজ ব্যক্তিদের বাড়িতে বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। স্বজনদের অনেকে বিলাপ করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। খানমরিচ ইউনিয়নের দাসমরিচ গ্রামের হনুফা খাতুন স্বামী, দুই ছেলে আর ভাইকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসা মানুষেরাও নিজেদের আবেগ ধরে রাখতে পারছে না। একই অবস্থা মুণ্ডুমালা গ্রামের জব্বার আলীর। নিখোঁজদের তালিকায় তাঁর দুই ছেলে রয়েছে। গ্রামের আসমা খাতুন জানান, প্রায় ১০ দিন আগে তাঁর স্বামী রফিকুল ইসলামসহ ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল মাটিকাটার কাজে মুন্সীগঞ্জ যান। সোমবার বিকেলেও স্বামী রফিকুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে তাঁর। স্বজনহারা পরিবারের সদস্যরা অবিলম্বে তাদের স্বজনদের উদ্ধারের দাবি জানিয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তারা বলে, যদি তাঁরা (নিখোঁজরা) বেঁচে না থাকেন তাহলে লাশগুলো উদ্ধার করে যেন তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পাবনার জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই পাবনা জেলা প্রশাসন মুন্সীগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। গতকাল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিখোঁজদের পরিবারগুলোকে কিছু ত্রাণ সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।





আরো খবর