২৮শে সেপ্টেম্বর ১৮৮৩। ঢাকার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিন। ওইদিনই ঢাকায় প্রথম টেলিফোন ব্যবহার শুরু করেন নবাব আহসান উল্লাহ। দিনটি সম্পর্কে তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন, আজ থেকে ঢাকায় টেলিফোন লাইন চালু হয়েছে। ঢাকা থেকে দিলকুশায় হাফিজুল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছি। এরপর বিবি সাহেবাগণও ফোনে কথা বলেন’।
নবাব আহসান উল্লাহর হাত ধরে শুরু হওয়া টেলিফোন এক সময় ঢাকায় পায় বিপুল জনপ্রিয়তা। বাড়িতে বাড়িতে ল্যান্ড ফোনের একটা ঐতিহ্য ছিল কয়েক বছর আগেও। তবে সে ঐতিহ্যে অনেকটাই ভাটা পড়েছে মোবাইল ফোনের জনপ্রিয়তায়।
বাড়িঘরে টেলিফোনে চাহিদা কমার পাশাপাশি কমেছে অফিসপাড়ায়ও। একটা সময় অফিস- আদালতে জরুরি বার্তা আদান-প্রদানে টেলিফোনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন কর্মকর্তারা। তবে সেটাও এখন তুলনামূলক কমে গেছে। একটি অফিসের যেকোনো তথ্য আদান-প্রদানে কর্মকর্তারা মোবাইল ফোন ব্যবহারেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
আদনান নামের এক সরকারি কর্মকর্তা জানান, অফিসে টিএন্ডটির লাইন থাকলেও সেটি এখন খুব একটা ব্যবহার হয় না। আমার সহকর্মী কিংবা কাজের ক্ষেত্রে অন্য সবার সঙ্গে আলাপে এখন মোবাইল ফোনই ব্যবহার করি। ল্যান্ডফোনটা এখন অকেজোই বলা চলে।
শাহরিয়ার নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকে টেলিফোনের ব্যবহার একেবারেই কমে গেছে। বছর কয়েক আগেও টেলিফোনের ওপর নির্ভর করতো সবাই। কিন্তু এখন মোবাইলেই যাবতীয় যোগাযোগ হচ্ছে। বিশেষ করে প্রতিটি ব্যাংক এখন মোবাইলে ব্যাংকিং সুবিধা দেয়ার কারণে গ্রাহকের সঙ্গে ওভাবেই সমন্বয় করছে। আর আমাদের সঙ্গে প্রধান শাখার কর্মকর্তাদেরও যোগাযোগ মোবাইলেই বেশি হচ্ছে।
বিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারা বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ গ্রাহক ল্যান্ডফোন ব্যবহার করছে। এদের বেশিরভাগই বিভিন্ন অফিস-আদালতের কাজে ব্যবহারের জন্য সংযোগ নেন। বাসাবাড়িতে সংযোগ থাকলেও সেটা সংখ্যায় অনেক কম। শুধু তাই নয়, আগে থেকে ল্যান্ড ফোন সংযোগ বাসায় নেয়া থাকলেও তা ব্যবহার করছেন না এমন গ্রাহকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এক কথায় ক্রমেই গ্রাহক হারাচ্ছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি বিটিসিএল’র ল্যান্ডফোন। হাতে হাতে মোবাইল ফোন আর আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঠিক পেরে উঠছে না এক সময়ের অতি প্রয়োজনীয় এই সেবা সংস্থাটি। ল্যান্ডফোনে গ্রাহক আগ্রহ বাড়াতে বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতের কথা বলছেন সাধারণ মানুষ।
বিটিসিএল-এর কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ মোরশেদ জানিয়েছেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ গ্রাহক ল্যান্ড ফোন ব্যবহার করছেন। দিন দিন গ্রাহক হ্রাস পাওয়া এবং সেটি বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলতে পারছি না। আমার কাছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই।
এদিকে টেলিফোনের সংযোগ সংখ্যা কমার দৌড়ে ব্যাপক হারে বেড়েছে মোবাইলের গ্রাহক। বিটিআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মোবাইল ফোনের সক্রিয় সংযোগ বা সিম সংখ্যা ১৪ কোটি ৭ লাখেরও বেশি। আর মোবাইলে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৯২ লাখ। বিশেষ করে মোবাইলে ইন্টারনেটের সুবিধা পাওয়ার কারণেও মানুষ যোগাযোগের ক্ষেত্রে মোবাইলই ব্যবহার করে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আজকাল মোবাইল- ইন্টারনেটের কল্যাণে মানুষের শুধু কথা বলাই সহজ হয়নি। হয়েছে একে অপরকে ভিডিও কলের মাধ্যমে দেখার সুযোগও। এ কারণেই দিন দিন ল্যান্ড ফোনের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে।
এই উপমহাদেশে ১৮৫৩ সালে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ল্যান্ড ফোনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বিভাগ। ১৯৭৬ সালে এ বিভাগটিকে একটি কর্পোরেট সংস্থায় রূপান্তরের পর, ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বিভাগকে পুনর্গঠন করে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি)। এরপর তারা দেশব্যাপী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান শুরু করে। ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগ আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) নামে আলাদা একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে টেলিযোগাযোগ খাতের নীতি নির্ধারণ ও তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়।
এরপর ২০০৮ সালে বিটিটিবিকে লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করে এর নতুন নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। বেসরকারি খাতেও ল্যান্ড ফোনের সেবা বিস্তৃত করা হয়। পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন) নামের এক ধরনের ফোন কোম্পানির সংখ্যা বিটিসিএলসহ মোট আটটি। বিটিসিএল-এর শতভাগ শেয়ার রাষ্ট্রের। অন্যদের গ্রাহক তেমন নেই। সব মিলিয়ে দেড় লাখের মতো হবে। এছাড়া বিটিসিএল-এর ল্যান্ড ফোনের জন্য নাগরিকদের সেই অতীতের আগ্রহ আর নেই। এখন চাইলেই ল্যান্ড ফোনের কানেকশন পাওয়া যায়। বিলও অনেক কম। অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল, ন্যাশনওয়াইড ডায়ালিং, সারা দেশে একই কলরেট, তারপরও সাধারণ মানুষ মোবাইলের জনপ্রিয়তার কারণে এর প্রতি আর আগের মতো আগ্রহী নন।