সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৬:১২

প্রকাশিতঃ মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই ২০১৮ ১২:২৮:২৭ অপরাহ্ন

তিন ধর্ষণে সিলেটে তোলপাড়

একজন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী, আরেকজন চতুর্থ শ্রেণির, অন্যজন নবম শ্রেণির। উচ্ছ্বলতায় মেতে থাকার বয়স তাদের। কিন্তু এই বয়সেই জগতের কঠিন, ভয়ানক রূপ দেখে বিমূঢ়, বিধ্বস্ত তারা। যাদের কাছে মানুষ আশ্রয় খোঁজে, সেই বাবা, ইমাম আর চিকিৎসকের বিকৃত লালসার শিকার হয়ে অদৃশ্য আগুনে পুড়ে ছাই ওই তিন ছাত্রীর উচ্ছ্বলতা। সিলেট নগরীর দর্জিপাড়া এলাকায় সৎ বাবার ধর্ষণের শিকার হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রী, সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন এক ইমাম; আর সিলেট শহরস্থ ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয়েছে ইন্টার্ন চিকিৎসককে। এই তিন ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় চলছে সিলেটে। ওঠেছে নিন্দার ঝড়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ওই ইমাম আর ইন্টার্ন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়ছেন সচেতন মানুষ। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, আমাদের সমাজে ইমাম ও চিকিৎসা পেশার সাথে জড়িতদের মর্যাদার চোখে দেখা হয়। সর্বস্তরের মানুষ তাদেরকে বিশ্বাস করে, আস্থা রাখে। এরকম অবস্থায় ইমাম আর চিকিৎসকই যদি ধর্ষণে জড়িয়ে যায়, তবে মানুষের আস্থার জায়গা আর থাকলো কোথায়। সচেতন মানুষ বলছেন, প্রকৃত বাবা হোক আর সৎ বাবাই হোক, তার কাছে যদি মেয়ে নিরাপদ না থাকে, তবে আমাদের সমাজ ক্রমেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। দেশে প্রতিনিয়তই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ইমাম, চিকিৎসক কিংবা সৎ বাবা দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা এখনও বিরল। এরকম অবস্থায় সিলেটের এই তিন ঘটনা সমাজচিন্তকদের ভাবিয়ে তুলছে। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এসব ঘটনাকে সামাজিক অবক্ষয় বলে চালিয়ে দেয়ার একটা প্রবণতা আছে। কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়ের চাইতে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা আছেন, তাদের দায়িত্বহীন এবং বিচারহীনতার কারণে এসব ঘটনা ঘটেই চলেছে। ’ তিনি বলেন, ‘আগের ঘটনাগুলোর বিচার যদি তড়িৎ গতিতে হতো, কোনো মামলায় নিম্ন আদালতে রায় হওয়ার পর যদি উচ্চ আদালতে মামলা দ্রুত সম্পন্ন হতো, তবে এসব ঘটনা ঘটতো না। এসব ঘটনায় সরকারের বদনাম হচ্ছে। এদিকে সরকারের দৃষ্টি দেয়া উচিত। ’ ‘ইমাম সাহেবরা তো বিভিন্ন সময় ফতোয়া দেন; এই ধর্ষণের ঘটনায় তারা কি বলেন, সেটা দেখার বিষয়। ওসমানী হাসপাতালে যে ঘটনা ঘটেছে, তার দায় হাসপাতালের পরিচালক এড়াতে পারবেন না। সব ঘটনায় দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইছি আমরা। ’ সৎ বাবার কাছে মেয়ে ধর্ষিত: দশ বছরের শিশু সে, সিলেট নগরীর একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। তার মায়ের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জে; বর্তমানে থাকেন সৌদি আরবে। তিনি প্রথমে বরিশালের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন। ওই সংসারে জন্ম নেয় শিশুটি। পরবর্তীতে ওই ব্যক্তির সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, শিশুটিকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন মা। কিছুদিন পর বগুড়ার গাবতলি থানার সরধনকুঠি গ্রামের পিটু মিয়াকে (২৮) বিয়ে করেন ওই মহিলা। গেল বছর সৎ বাবা পিটু মিয়ার কাছে নিজের শিশুকন্যাকে রেখে সৌদি যান তিনি। ওই শিশুকন্যাকে নিয়ে নগরীর দর্জিপাড়ায় থাকতেন পিটু। পুলিশ জানিয়েছে, গত প্রায় দুই মাস ধরে ওই শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করছিলেন পিটু মিয়া। কাউকে কিছু বললে মেরে ফেলার ভয়ও দেখাচ্ছিলেন পিটু। গেল শুক্রবার (১৩ জুলাই) দিবাগত রাতেও শিশুটিকে ধর্ষণ করেন তিনি। শনিবার সকালে মারপিট করে শিশুটিকে গোসল করিয়ে বাইরে যান পিটু। ভীতসন্ত্রস্ত শিশুটি পাশেই এক বান্ধবির বাসায় গিয়ে তার মাকে সব খুলে বলে। ওই বান্ধবির মা শরণাপন্ন হন পুলিশের। শনিবার দিবাগত রাতেই পিটু মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নগরীর কোতোয়ালী থানার ওসি মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, পিটু মিয়াকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। শিশুটিকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে। ইমামের কাছে শিশু ধর্ষিত: গত রবিবার (১৫ জুলাই) স্কুল ছুটির পর থেকে নিখোঁজ ছিল জকিগঞ্জ উপজেলার কালিগঞ্জ এলাকার পশ্চিম মহল্লার চতুর্থ শ্রেণির এক স্কুলছাত্রী। সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজে, পুকুর-ডোবায় তল্লাশি চালিয়েও মিলছিল না তার সন্ধান। সন্ধ্যার পর স্থানীয়রা কি মনে করে যেন পশ্চিম মহল্লার নতুন পাঞ্জেগানা মসজিদের ইমামের কক্ষে তল্লাশি চালান। সেখানেই, কক্ষের খাটের নিচের হাত-পা, মুখ বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায় শিশুটিকে। কিন্তু এর আগেই হাসান আহমদ (২৫) নামের ওই ইমামের ধর্ষণের শিকার হয়ে গেছে শিশুটি। হাসান আহমদ জকিগঞ্জের বারঠাকুরি ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের বাসিন্দা। জকিগঞ্জ থানার ওসি হাবিবুর রহমান হাওলাদার বলছেন, ‘পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হাসান আহমদ জানিয়েছেন, স্কুল ছুটির পর ওই শিশুটিকে ডেকে নিয়ে শরবতের সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ধর্ষণ করেন তিনি। হাসানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ’ চিকিৎসক যখন ধর্ষক: অসুস্থ নানির সাথে থাকতে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছিল নবম শ্রেণির ওই ছাত্রী। রবিবার (১৫ জুলাই) দিবাগত রাতেই সেখানেই ইন্টার্ন চিকিৎসক মাকামে মাহমুদ মাহী ধর্ষণ করেন মেয়েটিকে, এমনই অভিযোগ ওঠেছে। মাহীর বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছায়। ওই মেয়ের বাবা বলছিলেন, ‘ওসমানী হাসপাতালের তৃতীয় তলার ৮ নম্বর ওয়ার্ডে অসুস্থ নানির সাথে ছিল আমার মেয়ে। তাদের সাথে আর কেউ ছিল না। রবিবার দিবাগত মধ্যরাতে ফাইল দেখার কথা বলে তাকে একই ফ্লোরে নিজের কক্ষে ডেকে দরজা বন্ধ করে ধর্ষণ করে মাকাম এ মাহমুদ মাহী। সকালে আমরা আসার পর মেয়ে ঘটনাটি আমাদেরকে জানায়। ’ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হক বলেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা বৈঠকে বসি। সেখানে অভিযোগ অস্বীকার করেন মাহী। বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় সোমবার বেলা দেড়টার দিকে মাহীকে পুলিশের হাতে দেয়া হয়। ওই কিশোরীকে ওসিসিতে পাঠানো হয়েছে। ঘটনা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ওই ওয়ার্ডের সিসিটিভির ফুটেজও সংগ্রহ করা হচ্ছে। ’ নগরীর কোতোয়ালী থানার জ্যেষ্ঠ সহকারি পুলিশ কমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীর জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশে অভিযুক্ত মাকামে মাহমুদ মাহীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একের পর এক এসব ধর্ষণের ঘটনায় বাড়ছে উদ্বেগ। কিন্তু প্রতিকার কি? সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলছিলেন, ‘ধর্ষণের সকল ঘটনার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে হবে, অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে হবে। বিচারে যাতে দীর্ঘসূত্রিতা না হয়, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। ’
43A Railway Pde Lakemba, NSW 2195
email: editor@amardesh24.com
Copyright © 2016. Allright Reserved amardesh24.com