প্রকাশিতঃ শুক্রবার, ০২ অক্টোবর ২০২০ ০৪:১৩:৪৭ পূর্বাহ্ন
আমাদের ছেলেবেলায় আমরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগর কিংবা মহাত্মা গান্ধীর মতো মানুষদের সাথে নিয়ে বড় হয়েছি। ভালো করে কথা বলা শেখার আগে রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্ত করতে হয়েছে, কথা বলা শেখার পর নজরুলের কবিতা। ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে বিদ্যাসাগর পড়ালেখা করতেন এবং বাবার খাবার নষ্ট হবে বলে বিদ্যাসাগর কাউকে দেখতে না দিয়ে আস্ত তেলাপোকা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন, সেই গল্পটি আমাদের অনেকবার শুনতে হয়েছে। (তখনই টের পেয়েছিলাম আস্ত তেলাপোকা কখনো চিবিয়ে খেতে পারবো না বলে আর যাই হই কখনো বিদ্যাসাগর হতে পারবো না।)
শৈশবে সবচাইতে বড় সমস্যা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে। তাঁর সাথে পরিচিত হবার আগেই বিষাক্ত, দুর্গন্ধযুক্ত, গান্ধী পোকার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম এবং কেউ ভালো করে বুঝিয়ে দেয়নি বলে আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না একটা পোকা কেমন করে এতো ভালো ভালো কাজ করে। (এখন টের পাই শৈশবে আমি অন্য বাচ্চাদের থেকে অনেক বেশি হাবাগোবা ছিলাম।)
অপরিণত বয়সে কিছু বোঝার বয়স হওয়ার আগেই এই ধরনের অসাধারণ মানুষদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজটি ঠিক হয়েছে না ভুল হয়েছে সেটা নিয়ে বড় বড় মানুষেরা বিতর্ক করতে পারেন কিন্তু আমাদের একটা বড় লাভ হয়েছে। এই ধরনের মানুষগুলোকে এক ধরনের আপন মানুষ ভেবে ভেবে বড় হয়েছি। নুতন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা হয়তো জুকারবার্গ কিংবা ইলন মাস্কের কথা জেনে রোমাঞ্চিত হয়, ৭৫ থেকে ৯৬ এর সময়টিতে তারা সত্যিকারের বড় মাপের মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত শোনার সুযোগ পায়নি। সেই তুলনায় আজকালকার শিশু-কিশোরেরা খানিকটা সৌভাগ্যবান, তারা অন্তত বঙ্গবন্ধুর কথা শুনতে পারছে, জানতে পারছে।
এই বছর বিদ্যাসাগরের জন্মের দুই শতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। দুইশত বছর অনেক সময়, বিদ্যাসাগর পুরোনো কালের মানুষ সেটা আমরা সবাই জানি কিন্তু তিনি যে দুইশত বছর আগের মানুষ সেটা কখনোই সেইভাবে খেয়াল করিনি। কাজেই যখন বিষয়টা টের পেয়েছি তখন রীতিমতো চমকে উঠেছি। দুইশত বছর আগে এই দেশের মাটিতে এরকম একটা আধুনিক মানুষের জন্ম হয়েছিল? কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
আধুনিক শব্দটাই বিস্ময়কর। যে জিনিসটা আসলেই অসাধারণ সেটি হচ্ছে সত্যিকারের আধুনিক কোনো একটা বিষয় কখনোই পুরোনো হয়ে যায় না। ব্যাপারটা যাদের বুঝতে সমস্যা হয় তারা আমাদের সংসদ ভবনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পারেন, এটি অর্ধশতাব্দী থেকেও আগে তৈরি হয়েছিল, তখন আধুনিক ছিল, এখনো আধুনিক আছে, শত বছর পরেও আধুনিক থাকবে। আমার ধারণাটিতে যেকোনো ভুল নেই আমি তার প্রমাণ পেয়েছিলাম নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে গিয়ে, সেখানে মডার্ন আর্ট হিসেবে পেইন্টিং কিংবা ভাস্কর্য থাকার কথা, কিন্তু সেখানে লুই কানের নকশা করা আমাদের সংসদ ভবনটির একটি মডেল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের বিদ্যাসাগর ঠিক এ রকম একজন আধুনিক মানুষ, দুইশত বছর আগে তিনি আধুনিক ছিলেন এখনো তিনি আধুনিক আছেন।
যখন ছোট ছিলাম তখন ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে বিদ্যাসাগর লেখাপড়া করতেন কিংবা বাবার খাওয়া যেন নষ্ট না হয় সে জন্য তেলাপোকা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতেন সেই বিষয়গুলো জেনে আমরা চমৎকৃত হতাম। বড় হয়ে বুঝেছি তার জীবনের এই ঘটনাগুলো চমকপ্রদ ঘটনা সন্দেহ নেই কিন্তু এই ঘটনাগুলো তার সত্যিকারের পরিচয় নয়। আমরা বড় মানুষদের ব্যক্তিগত জীবন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ভালোবাসি তাই এগুলো খুঁজে খুঁজে বের করি। অনেক সময় দেখা যায় সেগুলো পুরোপুরি সত্যি নয়, কিংবা অনেক অতিরঞ্জিত।
নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার গল্প কিংবা আর্কিমিডিসের নগ্নদেহে রাজপথে ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করে ছুটে বেড়ানোর গল্প শত শত বছর ধরে টিকে আছে যদিও এগুলোর সত্যতার কোনো প্রমাণ নেই! আমি ব্যক্তিগতভাবে এর মাঝে কোনো দোষ দেখি না। আমার প্রায় দ্বিগুণ বয়সী আমার একজন আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু আমাকে বিষয়টা প্রথমে বলেছিল। সে আমাকে বলেছিল “Do not ruin a good story with facts!” (একটা ভালো গল্প সত্য তথ্য দিয়ে নষ্ট করে ফেলো না!) কাজেই আমরা যত ইচ্ছা বিদ্যাসাগর নিয়ে নানা ধরনের চমকপ্রদ গল্প শুনবো এবং বিশ্বাস করবো তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যে ঘটনাগুলোর জন্য তিনি দুইশো বছর পরেও আধুনিক সেগুলো যেন ভুলে না যাই!
এ রকম একটি হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিধবাবিবাহ। এটি নিয়েও একটা খুব সুন্দর গল্প প্রচলিত আছে। কিশোর বিদ্যাসাগর (তার আসল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়—যদিও সবাই তাকে বিদ্যাসাগর হিসেবেই জানে) একদিন তার গ্রাম বীরভূমে গিয়েছেন, সেখানে তার ছেলেবেলার খেলার সাথী বাচ্চা একটা মেয়ের সাথে দেখা হলো। মেয়েটার মুখটা শুকনো, বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কী খেয়েছিস?” মেয়েটি বলল, “না, না আজ একাদশী। একাদশীর দিন বিধবাদের খেতে হয় না!” বিদ্যাসাগর অবাক হয়ে দেখলেন বাচ্চা একটি মেয়ে এর মাঝে বিধবা হয়ে কী ভয়ানক একটা জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। বলা হয় কিশোর বিদ্যাসাগর তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন বড় হয়ে তিনি এই মেয়েদের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করবেন।
তখন ব্রিটিশ রাজত্ব, বিদ্যাসাগর বড় হয়ে সত্যি সত্যি বিধবাবিবাহ আইন পাস করিয়ে ফেললেন। কাজটা খুব সহজে হয়নি, হিন্দু নেতারা রীতিমতো গুন্ডা লাগিয়ে তাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল, বিদ্যাসাগরের বাবা তার ছেলেকে রক্ষা করার জন্য একজন লাঠিয়াল নিয়োগ করে দিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর কিন্তু হিন্দু ধর্মের রীতিনীতির বিরোধিতা করে হিন্দু বিধবাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেননি। তিনি রীতিমতো হিন্দুশাস্ত্র থেকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বিধবাবিবাহ একটি শাস্ত্রসম্মত ব্যাপার। তাই যুক্তিতর্ক দিয়ে কেউ বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করতে পারেনি, গায়ের জোরে বিরোধিতা করেছিল।
বিদ্যাসাগর শুধু যে একটা আইন করেই তার দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছিলেন তা কিন্তু নয়, তিনি রীতিমতো নিজের টাকা খরচ করে করে এরকম কম বয়সী বিধবা মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিষয়টা যে শুধু একটা আইনের ব্যাপার তা নয় তিনি যে এটাকে একেবারে নিজের মন থেকে বিশ্বাস করেন সেটাও আমরা জানি, তিনি নিজের ছেলেকেও একটি বিধবা মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন! (বিদ্যাসাগরের আপনজনের ভাগ্য খুব ভাল নয়, এই ছেলেটি তাকে অনেক যন্ত্রনা দিয়েছে, তার জামাইও খুব সুবিধের মানুষ ছিল না!)
বিদ্যাসাগর যে আধুনিক মানুষ ছিলেন তার দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য তার সত্যিকারের আগ্রহ। সারা পৃথিবীতেই এখনো মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারটা সহজ হয়নি। আমাদের দেশে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য এত রকম চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু আমরা কি জানি এই দেশের হাইস্কুলের ছাত্রীদের শতকরা ৮০ ভাগ মেয়েরা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়? আমাদের দেশের ছেলেরা যথেষ্ট সত্যবাদী তাদের শতকরা ৯৭ জন স্বীকার করেছে তারা মেয়েদের ইভটিজিং করে এক ধরনের বিমলানন্দ পেয়ে থাকে! তারপরও স্কুলপর্যায়ে ছাত্র থেকে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি, সে জন্য মেয়েদের প্রশংসা করতেই হয়।
কিছু মেয়ে যে ঝরে পড়ে না তা নয়, যারা ঝরে পড়ে তার ৭০ ভাগ থেকে বেশি মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় এই ইভটিজিংয়ের কারণে। এখনো যদি এ রকম অবস্থা হয়ে থাকে দুইশো বছর আগে কী রকম অবস্থা ছিল আমরা সেটা কল্পনা করতে পারি। সেই সময়ে বিদ্যাসাগর এক বছরেরও কম সময়ে একটি নয়, দুইটি নয়, ৩৫টি মেয়েদের স্কুল খুলে ফেলেছিলেন। তার কাণ্ড দেখে ইংরেজ সাহেবেরা যখন সেই সব স্কুলের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করল তখন তিনি নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন দিয়েছেন!
বিদ্যাসাগরকে একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার জন্য আরেকটি কারণ হচ্ছে তার বাংলা ভাষার জন্য ভালোবাসা। তিনি ঠিক ঠিক বুঝেছিলেন যে, যদি ছেলেমেয়েরা ঠিক করে ভাষাটাকেই না শিখে তাহলে লেখাপড়া করবে কীভাবে? তখন বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে তিনি পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন, ছাপার কাজে ব্যবহার করার জন্য বাংলা টাইপ তৈরি করেছেন। তার বর্ণপরিচয় বইটি এতই আধুনিক যে, আমার ধারণা এখনও সেটা দিয়ে শিশুদের বর্ণপরিচয় করানো সম্ভব! পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন বলে তখনকার বড় বড় সাহিত্যিকরা (ইচ্ছে করে তাদের নাম লিখছি না, আমি কারো বিরুদ্ধে মন বিষিয়ে দিতে চাই না।) তাকে অবজ্ঞা করতেন, কিন্তু সাহিত্য যেটুকু দরকার ভাষা যে তার থেকে বেশি দরকার সেটা বোঝার জন্য তো আর রকেট সাইন্টিস্ট হতে হয় না! (রকেট সাইন্টিস্ট একটা কথার কথা, রকেট সাইন্টিস্ট হওয়া এমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয়!)
শুরুতে বলেছিলাম বিদ্যাসাগরকে নিয়ে অনেক চমকপ্রদ গল্প প্রচলিত আছে সেই সব গল্প দিয়ে তাকে বিচার করলে তার পূর্ণাঙ্গ বিচার হবে না। তাকে ঠিকভাবে বিচার করতে হলে তাকে তার ভবিষ্যৎমুখী কাজগুলো দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু তার জীবনের গল্পগুলো এত মজার যে, সে রকম একটা গল্পের কথা না বলে পারছি না।
তখন ব্রিটিশ রাজত্ব, সেখানে টিকে থাকতে হলে ইংরেজি শিখতে হয় তাই বিদ্যাসাগর নিজের আগ্রহে চেষ্টা করে ইংরেজি শিখলেন। শুধু ইংরেজি শিখলে হয় না একটু ইংরেজি কায়দায় বেশভূষা করতে হয় সেখানে বিদ্যাসাগর আটকে গেলেন। তিনি তো ধুতি-চাদর ছাড়া আর কিছু পরেন না, পায়ে থাকে একজোড়া চটি! সে সময় তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক পেয়ে গেলেন, বড় অনুষ্ঠানে গিয়ে লাটসাহেবের কাছ থেকে সেই পদক নিতে হবে। কিন্তু সেখানে তো আর ধুতি-চাদর পরে যেতে পারবেন না, তাই সেই বড় অনুষ্ঠানে গিয়ে তার আর পদক নেয়া হলো না।
কিছুদিন পর দুইজন মানুষ সেই পদকটি কলেজে তার কাছে নিয়ে এলো। বিদ্যাসাগরের হাতে পদকটি তুলে দিয়ে সেই মানুষ দুইজন দাঁড়িয়ে রইলো। পদক নিয়ে এসেছে বলে তারা কিছু বকশিশ চায়! বিদ্যাসাগর যখন বুঝতে পারলেন তখন তাদের হাতে পদকটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা এই পদকটা দোকানে বিক্রি করে দাও। যে টাকা পাবে সেটা দুজনে ভাগ করে নিও! এই হচ্ছেন বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগরকে নিয়ে এ রকম গল্পের কোনো শেষ নেই! তবে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যে খুব সুখী হয়েছিলেন সেটা বলা যাবে না, শেষ জীবনটা সবাইকে ছেড়েছুড়ে তিনি সাঁওতালদের সাথে কাটিয়েছিলেন। একজন আধুনিক মানুষ যখন সময়ের অনেক আগে চলে আসেন তখন সবাই তাকে ভুল বুঝে। এটি তাঁদের জীবনের ট্রাজেডি।
কবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিক্রম, তিনি বিদ্যাসাগরকে কখনো ভুল বুঝেননি। সেই দেড়শ-দুইশ বছর আগে এই দেশে বাঙালির সংখ্যা ছিল চার কোটি, তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে নিয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, এই দেশে চার কোটি বাঙালি, আর মানুষ মাত্র একজন!
দুইশ বছর পরে সেই ‘একজন’ মানুষকে একটুখানি স্মরণ করি?