প্রকাশিতঃ সোমবার, ২৩ জুলাই ২০১৮ ০৩:৫৭:৪৩ পূর্বাহ্ন
মাহমুদুর রহমানের অবস্থার অবনতি, ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি
কুষ্টিয়ায় মানহানির এক মামলায় জামিন নিতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। এই হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন মাহমুদুর রহমান ও তার সঙ্গীরা। তবে পুলিশ হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি। আর কারা হামলা করেছে তা ছাত্রলীগ জানে না।
রবিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরে কয়েকজন আইনজীবীর সহযোগিতায় মাহমুদুর রহমান গাড়ি থেকে বের হন। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে মাহমুদুর রহমান ও তার সহযোগীরা যশোর হয়ে বিমানে ঢাকায় ফিরেন।
রাতে তাকে রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, উনার মাথায় আঘাত অত্যন্ত গুরুতর, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তাকে আইসিইউতে (গভীর পর্যবেক্ষণে) রাখা হয়েছে।
এদিকে হাসপাতালে ভর্তির খবর পেয়ে তার শুভাকাঙ্খীরা সেখানে ভিড় করলেও রাতে কাউকে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালে মাহমুদুর রহমানের এমন রক্তাক্ত দৃশ্য দেখে তার মা সন্তানকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিককে কটূক্তির অভিযোগে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ইয়াসির আরাফাত তুষারের করা মামলায় জামিন নিতে কুষ্টিয়ার আদালতে গিয়েছিলেন মাহমুদুর।
রবিবার বেলা ১২টায় কুষ্টিয়ার মুখ্য বিচারিক হাকিম এম এম মোর্শেদের আদালতে জামিন পাওয়ার পর বের হওয়ার সময় বাইরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিলে আদালত চত্বরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। বেশ কয়েক ঘণ্টা আদালত ভবনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন মাহমুদুর রহমান। ওই সময় তার সঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা বিএনপি সভাপতি সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমীসহ কয়েকজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
এক পর্যায়ে আদালতের এজলাসে আশ্রয় নেন মাহমুদুর রহমান। দীর্ঘ সময় একই পরিবেশ বিরাজ করায় তিনি আদালতকে বিষয়টি জানান এবং লিখিতভাবে পুলিশি নিরাপত্তার জন্য আবেদন করেন। দীর্ঘ ৪ ঘন্টা ১৫ মিনিট পর মাহমুদুর রহমান বের হয়ে একটি প্রাইভেটকার যোগে রওনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামলা শুরু হয়।
কয়েকজন আইনজীবীর সহায়তায় ওই গাড়ি থেকে পুনরায় আদালত ভবনে নিয়ে আসার আগেই রক্তাক্ত হয়েছে মাহমুদুর রহমানের শরীর। তখন আদালত প্রাঙ্গনের অবস্থা ছিল থমথমে।
হামলার পর মাহমুদুর রহমান বলেন, ৬৫ বছর বয়স আমার, আমি বাংলাদেশের জন্য জীবন দিবো, ওরা তো দিল্লির কুকুর, আমার দেশের জন্য আমি একা জীবন দিবো। পা চাঁটো গিয়া দিল্লির। আমার দেশের জন্য জীবন দিবো, ইসলামের জন্য জীবন দিবো
পরে বিকেলে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে পুলিশ পাহারায় আদালত চত্বর ছাড়তে দেখা যায়।
প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে যশোর বিমানবন্দরে থেকে বিমানযোগে ঢাকায় ফিরেছেন দৈনিক আমার দেশে পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব এম আবদুল্লাহ খবরটি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গাড়ি ভাঙচুরের সময় হামলাকারীরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল। ওই সময় হামলাকারীরা বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি করার জন্য মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান ও গালিগালাজ করতে থাকে। ঘটনার সময় পুরো আদালত প্রাঙ্গণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হামলাকারীরা প্রথমে গাড়িটির সব কাঁচ ভেঙে ফেলে। পরে ভাঙা কাঁচের ভেতর দিয়ে লাঠি ও ইট পাটকেল দিয়ে আঘাত করে। ওই আঘাতে আহত হন মাহমুদুর রহমান।
হামলার পর পুলিশের উদ্দেশ্য মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ পাহারা দিয়ে আমার ওপর হামলা করালো। মরে যাব তবুও আমার সংগ্রাম চলবে।’
মাহমুদুরের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশ) মহাসচিব এম আব্দুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বেলা সাড়ে ৪টার দিকে তিনি বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়ে তাকে রক্তাক্ত জখম করে। এসময় তার গাড়িও ভাংচুর করা হয়।’
সাংবাদিক নেতা এম আবদুল্লাহ আরো জানান, শুনানি শুরু হওয়ার আগ থেকেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে আদালত ভবন ঘেরাও করে থাকে। এ সময় মাহমুদুর রহমান কয়েকবার আদালত ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পুলিশের সেল্টারে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা লাঠিসোটা নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণ ঘেরাও করে রাখে। এ ব্যাপারে বার বার কুষ্টিয়ার এসপিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা চেয়েও ব্যর্থ হন সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ।
আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা এ পরিস্থিতি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানালে, তিনি আমাদেরকে তার কক্ষে বসতে দিয়েছেন। আমরা দীর্ঘক্ষণ ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে বসে ছিলাম। বেলা পৌনে ৫টার দিকে আদালত কক্ষ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।
আদালত পুলিশের পরিদর্শক মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বেলা সাড়ে ৪টার দিকে তিনি সেখান থেকে বের হয়ে গাড়িতে করে যাওয়ার সময় কে বা কারা গাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে। এ সময় ভাঙা কাচ লেগে তিনি রক্তাক্ত জখম হন।’
আদালতের এপিপি সাজ্জাদ হোসেন সেনা জানান, মাহমুদুর এ মামলায় উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে ছিলেন। রবিবার স্থায়ী জামিনের জন্য নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেন।
এবিষয়ে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ইয়াসির আরাফাত তুষার বলেন, ‘আমি এই মামলার বাদী হিসেবে আজ কোর্টে গিয়েছি। এ সময় কেউ যদি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হন তার জন্য তো আমি দায়ী নই। এই মামলার বিবাদীর উপর কে বা কারা হামলা করেছে সেটাও আমি জানি না।’
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার নাতনি টিউলিপকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসিন আরাফাত তুষার কুষ্টিয়ায় মানহানির মামলা দায়ের করেন।
এদিকে মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার প্রতিবাদে নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশ। বিএফইউজের (একাংশ) সভাপতি রুহুল আমীন গাজী, মহাসচিব এম আবদুল্লাহ, ডিইউজের (একাংশ) সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুল ইসলাম এক বিবৃতিতে হামলাকারীদের শাস্তি দাবি করেন।
এছাড়া মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার প্রতিবাদে নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘মাহমুদুর রহমান হামলার কথা বুঝতে পেরে কোর্টে অবস্থান নেন। পরে কোর্টের ওসির কথায় তিনি আদালত থেকে বের হয়ে আসেন। বলতে গেলে কোর্টের ওসি জোর করে মাহমুদুর রহমানকে বের করে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেয়।’
মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার ঘটনায় ধিক্কার জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা দ্রুত হামলাকারীদের চিহ্নিত করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার দাবি জানাচ্ছি। এ হামলার মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলে দেশের প্রতিটি সেক্টর সরকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়েছে, রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান এখন আর জনগণের কাজে আসছে না।
মির্জা ফখরুল আরো বলেন, ‘একমাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এ স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে। না হলে শুধু মাহমুদুর রহমান নয়, কোনো নাগরিক আদালত বা কোথাও নিরাপদ থাকবে না।’