শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৮:১৮

প্রকাশিতঃ মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ ২০১৯ ০৩:২৭:৪৮ পূর্বাহ্ন

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্যই ছিল

উত্তাল মার্চ আরও উত্তপ্ত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছে বাঙালির। ওদিকে গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালিকে স্তব্ধ করে দেয়ার ছক কাটছে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ষড়যন্ত্রের কৌশল হিসেবে ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তাকে বাঙালিদের পক্ষ থেকে কোনো স্বাগত জানানো হয়নি। বিমানবন্দরের সব পথ সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। চারদিকে সৈন্যরা পাহারায় ছিল। প্রেসিডেন্টকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল ১৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য। মেশিনগানে সজ্জিত ছিল গাড়ি। ঢাকা সফর সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন- ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশের অতিথি হিসেবে স্বাগত জানানো হবে।’ ইয়াহিয়ার বিমান শ্রীলংকা ঘুরে ঢাকায় পৌঁছে বিকাল ৩টায়। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কতটা নাজুক ছিল তা পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিকের গ্রন্থে (উইটনেস টু সারেন্ডার) জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি অনেক প্রেসিডেন্ট আর দেশের প্রধানদের আগমন দেখেছি, কিন্তু ১৫ মার্চ ঢাকায় যে পরিবেশের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এসে অবতরণ করলেন, তা আমি কখনই ভুলব না। বিমানবন্দরে প্রবেশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। টার্মিনাল ভবনের ছাদের ওপর স্টিলের হেলমেট পরা প্রহরীদের দাঁড় করান হয়। বিমানবন্দর ভবনের প্রতিটি সদস্যকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়। পিচঢালা পথে প্রবেশের একমাত্র রাস্তা পিএএফ গেটে সেনাবাহিনীর ভারি অস্ত্রে সজ্জিত একটা দলকে বসানো হয়। পদাতিক সৈন্যের (১৮ পাঞ্জাব) ট্রাকভর্তি একটি কোম্পানি (প্রায় ১০০ জনের) ফটকের বাইরে মেশিনগান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে করে শহরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করা অল্প কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিমানবন্দরের ভেতরে থাকার অনুমতি দেয়া হয়। তাদের বিশেষ নিরাপত্তা পাস দেয়া হয়। কোনো ফুলের তোড়া ছিল না, ছিল না কোনো বেসামরিক কর্মকর্তা, শহরের অভিজাতদের কেউ নেই, নেই সাংবাদিকদের ধাক্কাধাক্কি বা ক্যামেরার ক্লিক। এমন কি সরকারি ফটোগ্রাফারকেও অনুমতি দেয়া হয়নি। এ ছিল এক অদ্ভুত ভীতিকর পরিবেশ, যেখানে জড়িয়ে ছিল মৃত্যুর স্তব্ধতা।’ ১৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেন। এ বৈঠক প্রায় আড়াই ঘণ্টা চলে। ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে ইয়াহিয়ার তখন কার্যত বন্দিদশা। বিরাট সশস্ত্র রক্ষীদল ছাড়া তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। পূর্ব পাকিস্তানে তখন শেখ মুজিবের কিংবা তার দলের নির্দেশ ছাড়া কিছুই চলছিল না, কোনো কাজই হচ্ছিল না। আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলিই ছিল তখন দেশের সর্বোচ্চ আইন। ইয়াহিয়া কর্তৃত্ব প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়া খানের প্রতি মানুষের তেমন একটা আস্থা ছিল না। ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছিল এ বৈঠক ছিল ভুট্টো-ইয়াহিয়ার একটি সাজান নাটক। সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছু নয়। একদিকে ঢাকায় ইয়াহিয়া খান আলোচনার মাধ্যমে অগ্রগতি ঘটাতে চাইছেন, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো দম্ভোক্তি করছেন যে তাকে ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তা প্রতিহত করবেন। এ দিনই ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন। মূল অপারেশনাল পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়নের জন্য ১৮ মার্চ সকালে জিওসির কার্যালয়ে মেজর জেনারেল খাদিম রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি বৈঠকে বসেন। এ সময় সম্ভবত গণহত্যার পরিকল্পনা পাকা করা হয়। ১৯ মার্চ বেলা ১১টায় মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে বৈঠকের ফল জানার জন্য। বৈঠক শেষ হলে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো কিছুর আশা করছি এবং সবচেয়ে খারাপের জন্যও প্রস্তুত রয়েছি।’ এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনার অচলাবস্থার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। একই দিন সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টা হিসেবে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং ড. কামাল হোসেনের মধ্যে দুই ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা চলে। ঠিক একই সময়ে, ১৯ মার্চ ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রারম্ভিক বিস্ফোরণ ঘটল বলা যেতে পারে। বিক্ষুব্ধ জনতা পাক সৈন্যদের পথে দৃঢ় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় দু’জন নিহত ও পাঁচজন আহত হয় বলে সরকার স্বীকার করে। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী এখানে সেদিন আনুমানিক ১৫০ জন নিহত হয় বলে জানা যায়। একই দিনে পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি প্রদান করে বলেন, ‘যারা মনে করেন, তাদের বন্দুকের বুলেট দিয়ে জনগণের সংগ্রাম বন্ধ করতে সক্ষম হবেন তারা আহাম্মকের স্বর্গে আছেন।’ ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠকে ইয়াহিয়া মুজিবের কাছে ‘জয় বাংলা’ কথাটির অর্থ জানতে চান। মুজিব সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময়েও তিনি কালেমা পাঠের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করবেন।’ এই দিন রাতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছুসংখ্যক সৈন্য টাঙ্গাইল থেকে জয়দেবপুরে আসছিল। পথে বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের থামিয়ে কয়েকজন সৈন্যকে আটক করে এবং তাদের কাছ থেকে ৪টি রাইফেল ও কয়েকটি স্টেনগান ছিনিয়ে নেয়। ২০ মার্চ একদিকে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক চলছিল, অন্যদিকে লে. জেনারেল আবদুল হামিদ ও লে. জেনারেল টিক্কা খান গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করার একটি পরিকল্পনা ছিল। ইয়াহিয়া খান আপাতত এ পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেন। এদিন কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য ঢাকায় এলেন। ভুট্টোও ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণের জবাবে জানালেন, তিনি প্রেসিডেন্টের জবাবে সন্তুষ্ট এবং শিগগিরই ঢাকা আসছেন। এ ‘সন্তুষ্ট’ বলতে তিনি কি বোঝালেন তা প্রকাশ করলেন না। এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ ঢাকায় এসে বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন শুরু করলেন। ২৩ মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক স্থগিত থাকে। এদিন ছিল পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিক দিবস। দিবসের স্বাভাবিক অনুষ্ঠানগুলো বাতিল করা হল। ইয়াহিয়া খান এমন ভান করলেন যেন তিনি একটি মীমাংসার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ব্যস্ত আছেন। এ দিবসে একটি দুঃসাহসিক কাজ করে ছাত্র-জনতা। তারা পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে, জয় বাংলা বাহিনীর চারটি প্লাটুন মার্চ পাস্ট করে বাংলাদেশের পতাকাকে অভিবাদন জানান। এই জয় বাংলা বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়। ২৩ মার্চকে আওয়ামী লীগ ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। তারা পাকিস্তানের পতাকা পোড়ায়, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে। তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। একই সঙ্গে খুব ঘটা করে টানানো হয় বঙ্গবন্ধুর ছবি। রেডিও এবং টেলিভিশনে নতুন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার সোনার বাংলা গানটি বাজানো হয়। সারা শহরে এ পতাকা উড়তে থাকে। এদিন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। করাচি থেকে এমভি সোয়াত নামে একটি জাহাজ এসে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে। বন্দরের শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই অস্ত্র খালাস না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের বিশ্বাস এসব অস্ত্র বাঙালিদের হত্যা করার কাজে ব্যবহার করা হবে। শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শেষে সিদ্ধান্ত হয় এ অস্ত্র খালাস করা হবে; কিন্তু তা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যেতে দেয়া হবে না। এগুলো রাখা হবে বন্দরের ট্রানজিট ক্যাম্পে। ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ এক নতুন প্রস্তাব নিয়ে আসে। আগের শাসনতান্ত্রিক কমিটির প্রস্তাব বাদ দিয়ে শাসনতান্ত্রিক কনভেনশনের প্রস্তাব দেয়া হবে। ইসলামাবাদ এবং ঢাকা থেকে দুটো কমিটি আলাদা করে রিপোর্ট জমা দেবে। এ দুই রিপোর্ট নিয়ে জাতীয় পরিষদে বৈঠক বসবে এবং এর ভেতর থেকে একটি সমাধান বের করার চেষ্টা নেয়া হবে। ২৩ মার্চ থেকে ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরুর পূর্ব পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ড. কামাল হোসেনের গ্রন্থের একটি অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘২৪ মার্চ সন্ধ্যার বৈঠকের জন্য যখন আওয়ামী লীগের আলোচক দল রওনা হতে যাচ্ছে, তখন শেখ মুজিব বলে দিলেন, রাষ্ট্রের নামের জন্য আমরা যেন ‘পাকিস্তান কনফেডারেশন’ (Confederation of Pakistan) নামটি প্রস্তাব করি। তিনি ইঙ্গিত দিলেন আমরা যেন ব্যাখ্যা করি যে জনগণের অনুভূতির স্বার্থে এর প্রয়োজন রয়েছে। এ প্রস্তাব স্বাধীনতার জন্য জনগণের অনুভূতির তীব্রতা আংশিকভাবে হলেও প্রতিফলিত হয়, কারণ উত্তালভাবে এগিয়ে চলা গণ-আন্দোলনের অগ্রবাহিনীর তরুণ জঙ্গি নেতাদের দ্বারাই তা উদ্ভাবিত ও উচ্চারিত (articulated) হয়েছিল। ...২৫ মার্চের ভয়াবহ রাতের আগে সারাক্ষণ আমি একটি টেলিফোন পাওয়ার অপেক্ষা করলাম। ওই টেলিফোন কখনোই আসেনি। এমনকি ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আমি যখন শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম, তখন শেখ মুজিব জানতে চাইলেন, আমি ওই টেলিফোন পেয়েছি কি না। আমি তাকে জানালাম, আমি তা পাইনি। ওই রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি জনগণের ওপর আক্রমণ চালাল এবং গণহত্যা ও রক্তস্নান শুরু হল, যা এড়ানোই ছিল আলাপ-আলোচনা চালানো ও দরকষাকষির মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছানোর প্রয়াসের প্রধান লক্ষ্য।’ (ড. কামাল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল, ঢাকা, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৬, পৃ. ৯৩-৯৫)। বঙ্গবন্ধুর কাছেও স্পষ্ট ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য মুক্তির লড়াই এখন অনিবার্য। তবুও তিনি সতর্ক ছিলেন বাঙালিকে যেন পাকিস্তান ভাঙার অভিযোগে অভিযুক্ত করা না হয়। সেই অর্থে বলা যায়, ২৬ মার্চের নতুন সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল বিচক্ষণতার আর কৌশলের। অন্যদিকে পাকিস্তানি জান্তার চিন্তা ছিল অমানবিক ও আসুরিক। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে মধ্যরাতের গণহত্যার মধ্য দিয়ে। ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
43A Railway Pde Lakemba, NSW 2195
email: editor@amardesh24.com
Copyright © 2016. Allright Reserved amardesh24.com