প্রকাশিতঃ শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ ০৭:২৯:২২ পূর্বাহ্ন
বীরদের এক বাহিনী ফায়ার সার্ভিস
মেঘনায় লঞ্চ ডুবেছে। শত শত মানুষ নিখোঁজ। ২০১২ সালের মার্চ মাস। উদ্ধারকারী জাহাজে বসে বসে মানুষের আহাজারি দেখছি। নিউজ লিখে পাঠাচ্ছি।
ঘটনার দুদিন পর স্বজনেরা আর জীবিত নয়, লাশের জন্য আহাজারি করছে। এই বাহিনী সেই বাহিনীর দেশি বিদেশি ট্রেনিং পাওয়া নানা লোকজন আসছে আধুনিক সব যন্ত্রপাতি নিয়ে।
তারা পানির নিচে যায়। কিন্তু লাশ পায় না। সেই সময়ে হাজির হলেন রুগ্ন লিকলিকে শরীরের ফায়ার সার্ভিসের এক ডুবুরি। একেকটা ডুব দেয়। দুইটা করে লাশ তোলে। কিছুক্ষণের মধ্যে একাই ৩০-৩৫ টা লাশ তুললো। সব বাহিনীর সদস্যরা বিস্ময় নিয়ে দেখছে।
লোকটার নাম আবুল খায়ের। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি। অসম্ভব সাহসী মানুষ। প্রচণ্ড স্রোত বা যতো প্রতিকূল পরিস্থিতি হোক, ডাক পড়ে খায়েরের।
উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতে চায়, আবুল খায়ের, তুমি কি যেতে পারবে?’
তার উত্তর, ‘পারব স্যার। কিন্তু ফিরে আসতে পারব, সে আশা নাই। আমি মারা গেলে স্যার লাশটা বাড়িতে পাঠায় দিয়েন।'
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটা সদস্য যেন একেকজন আবুল খায়ের।
শুধু কী লঞ্চডুবি! ১৫ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে একের পর এক লঞ্চডুবি, রানা প্লাজায় ভবন ধ্বস, তাজরীন, নিমতলী সবই দেখতে হয়েছে।
অনেক বাহিনীকে দেখেছি কাজ করে বা না করে কৃতিত্ব নিয়েছেন। কিন্তু প্রতিটা ঘটনায় দেখেছি ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করছেন।
বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটা সদস্য আমার বীর মনে হয়। মনে হয়, অন্য অনেক বাহিনীর মতো আধুনিক যন্ত্রাপাতি বা পেশাদারিত্ব থেকে হয়তো তারা অনেক পিছিয়ে, কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটা সদস্য তাদের মমত্ববোধ নিয়ে, মানবপ্রেম নিয়ে, নিরলস চেষ্টা নিয়ে সবার থেকে এগিয়ে।
আপনারা হয়তো, চকবাজারের আগুনের পর ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের একটা ছবি দেখেছেন যেখানে দেখা যায়, অভিযান সম্পন্ন করার পর তারা এতটাই ক্লান্ত যে, গাড়ির সামনের আসনে এমন কী গাড়ির ছাদেও ঘুমাচ্ছিলেন।
একবার ভাবুন। বুধবার রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে আগুন লাগার পরপরই ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষের জীবন রক্ষার কাজ শুরু করেছেন।
পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২২ মিনিটে অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা পর্যন্ত টানা ১৪ ঘন্টা নাওয়া খাওয়া ভুলে কাজ করেছেন ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিটের কয়েকশ সদস্য।
সবাইকে আরেকবার মনে করিয়ে দেই, প্রতিষ্ঠানটার পুরো নাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। বৃটিশ সরকার অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৯-৪০ অর্থ সালে ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টি করেন।
বিভক্তিকালে আঞ্চলিক পর্যায়ে কলকাতা শহরের জন্য কলকাতা ফায়ার সার্ভিস এবং অবিভক্ত বাংলায় বাংলার জন্য বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টি করেন।
১৯৪৭ সনে এ অঞ্চলের ফায়ার সার্ভিসকে পূর্ব পাকিস্তান ফায়ার সার্ভিস নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৫১ সনে আইনী প্রক্রিয়ায় সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর সৃজিত হয়।
১৯৮২ সালে ফায়ার সার্ভিস পরিদপ্তর, সিভিল ডিফেন্স পরিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের উদ্ধার পরিদপ্তর-এই তিনটি পরিদপ্তরের সমন্বয়ে বর্তমান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরটি গঠিত হয়।
শুরু থেকেই নানা সংকটে কাজ করতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে। গত কয়েকবছরে প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা অনেক বাড়লেও বর্তমানে স্থান, জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকট আছে এই বিভাগে।
আর ওই যে লেখার শুরুতে খায়েরকে নিয়ে কথা বলছিলাম যার জীবনটা বীরের, গোটা দেশের সব বাহিনী মিলে যেখানে একজন খায়ের বিরল, সেই খায়েরের সংসার চলে অতিকষ্টে। ছেলেটা তার লেগুনা চালায়। স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত বলে জানতাম। অনেকদিন ধরে খোঁজ জানি না।
খায়েরের মতোই নানা সংকটে আমাদের ফায়ার সার্ভিস। তারপরেও দেখবেন, দিন হোক, গভীর রাত হোক, একটা ইমার্জেন্সি কলেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সাইরেন বাজিয়ে সবার আগে হাজির ঘটনাস্থলে। আরও অনেক বাহিনীর সদস্যদের দেখবেন হয়তো ঘটনাস্থলে।
কিন্তু ফায়ারের সদস্যরা এমনভাবে কাজ করছেন মনে হবে, তাদেরই সন্তান বা স্বজন বিপদে পড়েছে। এমন মমত্ববোধ সত্যিই বিরল।
আমার জানা মতে, শুধু আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়েই গত সাত বছরে অন্তত ১২ জন ফায়ার সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছে আরও অনেকে। জানি না কোন পদক জুটেছে কী না তাদের। অন্য অনেক বাহিনী নানা কৃতিত্ব পায়। কৃতিত্ব ছিনতাইও করে।
কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা চুপ করে কাজ করে যান। বাংলাদেশে আনসাং হিরো শব্দটা তাদের জন্যই। মরার এই শহরে, দুর্যোগের এই দেশে তারাই আসল নায়ক। তাই এই বাহিনীর প্রতিটা সদস্যকে স্যালুট। আপনারাই আমার কাছে বাংলাদেশ। স্যালুট তাই আপনাদের।