সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৯:৪৫

প্রকাশিতঃ বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:২৪:২০ পূর্বাহ্ন

সবচেয়ে কম বেতন পায় চা শ্রমিক

মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে চা শ্রমিকদের দাস হিসেবে ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশরা। সেই শাসক শ্রেণি চলে গেলেও বঞ্চনা যেন এখনো রয়ে গেছে। পুরো দেশের উন্নয়ন হলেও চা শ্রমিকদের জীবনমানে খুব একটা উন্নয়ন নেই। আইন থাকলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসনসহ সব দিকেই তারা বঞ্চনার শিকার। এমনকি দেশের উল্লেখযোগ্য ১১টি খাতের মধ্যে সবচেয়ে কম বেতনে চাকরি করে চা শ্রমিকরা। গতকাল মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) চা শ্রমিকদের ওপর প্রকাশিত ‘চা বাগানের কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষক দিপু রায়। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানসহ প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। গবেষণায় বলা হয়েছে, চা বাগানের শ্রমিকদের সর্বশেষ চুক্তিতে দৈনিক মজুরি মাত্র ১০২ টাকা ধরা হয়েছে, যা দেশের অন্য খাতের শ্রমিকদের তুলনায় বেশ কম। একজন স্থায়ী শ্রমিক মাসে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ২৩১ টাকা বেতন পায়। বেতন অনুযায়ী জাহাজ ভাঙা শিল্প, ট্যানারি, অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল, ফার্মাসিকিউটিক্যালস, তৈরি পোশাক, টি প্যাকেজিং, স মিলস, বেকারি বিস্কিট কনফেকশনারি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ ও কটন ইন্ডাস্ট্রিজের পরে রয়েছে চা শ্রমিকদের অবস্থান। তবে এই বেতনও অনেক বাগান মালিক ঠিকমতো দেন না। গবেষণার আওতায় থাকা ৬৪টি বাগানের মধ্যে ২৮টি বাগানে অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীদের সমান মজুরি দেওয়া হয় না। দৈনিক মজুরি ৮৫ টাকার জায়গায় ৫০-৭৫ টাকা দেওয়া হয়। এর ওপর আবার শ্রম আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিক তিন মাস সন্তোষজনক শিক্ষানবিস কাল পার করার পরে স্থায়ী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কথা থাকলেও ৬৪টি বাগানের কোনোটিতেই তা মানা হচ্ছে না। মাত্র ১৪টি বাগানে অস্থায়ী শ্রমিকদের মধ্য থেকে বছরে ১০-১২ জনকে স্থায়ী করা হয়। স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পেতে ৪৪.২ শতাংশ শ্রমিককে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যার মধ্যে ৯৪.৪ শতাংশ শ্রমিককে গড়ে ছয় বছর অস্থায়ী হিসেবে কাজ করতে হয়। শ্রমিকরা যে পরিমাণ চা পাতা উত্তোলন করে নিয়ে আসে সেখানেও হিসেবে গরমিল করা হয়। ৬৪টি বাগানের মধ্যে অধিকাংশ বাগানে অ্যানালগ মেশিনে পাতার ওজন করা হয় ও মেশিনের ওজন পরিমাপের নির্দেশক একমুখী হওয়ায় তা শ্রমিকদের পক্ষে দেখা সম্ভব হয় না। কোনো শ্রমিক ওজনের পরিমাপ নির্দেশক কাঁটা দেখার চেষ্টা করলে বাবু তাকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দেয় এবং কেউ কাঁটা দেখতে একটু জোর করলে তাকে পরবর্তী সময় বিভিন্ন উপায়ে অলিখিত শাস্তি ভোগ করতে হয়। গামছার ওজন, পরিবহনের সময় পাতা পড়ে যাওয়া, বৃষ্টি হলে পাতার ওজন বেড়ে যাওয়া এবং কোনো কারণ ছাড়াই নানা অজুহাতে পাতার ওজন কম ধরা হয়। এক সপ্তাহের একটি হিসাবে দেখা যায়, প্রায় ৩১ লাখ দুই হাজার ৪৩৫ টাকা মূল্যের চা পাতা হিসাবে কম ধরা হয়েছে। তবে আটটি বাগানে ডিজিটাল মেশিনে ওজন পরিমাপ করা হয়। কাজের জায়গায় খাবার পানি ও টয়লেট নিয়ে শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক চা বাগানের কাজের জায়গায় পর্যাপ্ত খাবার পানি সরবরাহের সুব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও কোনো বাগানেই স্থায়ী ব্যবস্থা যেমন—নলকূপ বা কুয়ার ব্যবস্থা নেই। ২৩টি বাগানে প্রবহমান ছড়া, ঝরনা, কুয়া, নদী, খাল থেকে অস্বাস্থ্যকর পাত্রে পানি সংগ্রহ করে শ্রমিকদের দেওয়া হয়, যা শ্রমিকরা হাত পেতে পান করে। কোনো গ্লাসের ব্যবস্থা করা হয় না। বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিটি সেকশনে প্রয়োজনীয়সংখ্যক শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও কোনো বাগানেই তা নেই। তাদের নিরাপত্তায় বাগানে ক্ষতিকর প্রাণী থেকে বাঁচতে কীটনাশক ব্যবহারের কথা থাকলেও তা করা হয় না। সর্বশেষ চুক্তি অনুযায়ী পরিবারের সর্বোচ্চ তিনজন পোষ্য বাবদ রেশন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ৬১টি বাগানের মধ্যে ছয়টি বাগানে পোষ্যদের রেশন দেওয়া হয় না। যারা রেশন পায় তাদের মধ্যে ১৮ শতাংশ উত্তরদাতা সব সময় এবং ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা মাঝেমধ্যে ওজনে কম দেওয়ার কথা বলেছে। যারা কম দেওয়ার কথা বলেছে তাদের গড়ে ৬২৯ গ্রাম রেশন কম দেয় এবং এই কম দেওয়ার পরিমাণ সর্বনিম্ন ৫০০ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ১৪০০ গ্রাম পর্যন্ত। আবার ৬৮.৯ শতাংশ শ্রমিক জানায়, বাগান থেকে যে রেশন দেওয়া হয় তা দিয়ে তাদের প্রয়োজন মেটে না। আবাসনের বেলাতেও নানা ঝামেলা পোহাতে হয় শ্রমিকদের। শ্রম বিধিমালায় বাগান মালিক কর্তৃক প্রতিটি শ্রমিক ও তার পরিবারের বসবাসের জন্য বিনা মূল্যে বাসগৃহের ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও বাংলাদেশ টি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ৩২ হাজার ২৯৯ জন স্থায়ী শ্রমিক ও অন্য অস্থায়ী শ্রমিকদের জন্য আলাদা কোনো আবাসন বরাদ্দ করা হয়নি। তবে মাত্র তিনটি বাগানে কর্তৃপক্ষ কলোনির আদলে দুই কক্ষবিশিষ্ট কিছু নতুন আবাসন তৈরি করেছে। প্রত্যেক বাগানে হাসপাতাল বা ডিসপেনসারি প্রতিষ্ঠা করার নিয়ম থাকলেও জরিপকৃত ৬৪টি বাগানের মধ্যে ১১টি বাগানে চিকিৎসাকেন্দ্র বা ডিসপেনসারি নেই। ৪১টি বাগানের চিকিৎসাকেন্দ্রে অন্তর্বিভাগীয় চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা নেই, ২১টি চিকিৎসাকেন্দ্রে কোনো প্রকার বেড নেই। প্রতিটি বাগানেই মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকার কথা থাকলেও মাত্র সাতটি বাগানে রয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিকদের সন্তানদের বিনা মূল্যে প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য বাগানপ্রতি একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও মাত্র ২৪টি বাগানে কর্তৃপক্ষের স্কুল আছে এবং ৪০টি বাগানে কোনো স্কুল নেই। জরিপে উঠে এসেছে ৫১.৪ শতাংশ পরিবারের ছয় থেকে ১২ বছর বয়সী ছেলে-মেয়ে রয়েছে যার মধ্যে ৮৪.২ শতাংশ স্কুলে যায়। তবে এর মধ্যে মাত্র ২১.৫ শতাংশ যায় বাগানের স্কুলে। বাকি ৭৮.৫ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এনজিও স্কুল ও অন্যান্য স্কুলে যায়। এসব বিষয় দেখভাল করতে যাঁরা পরিদর্শন করেন তাঁরা মালিকদের কাছ থেকে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে চলে যান। সঠিক চিত্র উঠে আসে না তাঁদের কথায়। তবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশদের যে শাসন সেটাই পরিবর্তিতভাবে রয়ে গেছে। যে কারণে শ্রমিকরা নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। অস্থায়ীরা বেতন ছাড়া আর কোনো সুবিধাই পায় না। এখানে মজুরি এখনো সর্বনিম্ন। যদিও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত, যা অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এখনো এখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সার্বজনীনতা নেই। তাই সবার আগে এখানে অন্যান্য খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। মালিকরা এসব বিষয় উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলেও জানান তিনি
43A Railway Pde Lakemba, NSW 2195
email: editor@amardesh24.com
Copyright © 2016. Allright Reserved amardesh24.com