মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০৭:৫০

প্রকাশিতঃ বৃহস্পতিবার, ১৬ আগস্ট ২০১৮ ০৫:০১:৫৫ পূর্বাহ্ন

কোরবানির পশু বিক্রিতে শিক্ষিত, চাকরিজীবীও

ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে ভিন্ন পেশার শিক্ষিত লোকজনও যুক্ত হচ্ছেন পশুপালন ও বেচাকেনায়। শিক্ষার্থী, ব্যাংকার, বড় প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বেশ আয়োজন করেই নেমেছেন মৌসুমি এ ব্যবসায়। কোরবানির জন্য বিক্রি করতে ঈদের সাত-আট মাস আগে থেকে পশু পালন শুরু করেন তাঁরা। রীতিমতো খামার গড়ে পশু পালন করে বিক্রি করেন। সরকারি ভাষ্য, ভারত থেকে পশু আনা বন্ধ হওয়ায় তিন বছর ধরে ভিন্ন পেশার লোকজনের মৌসুমি এই ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। লাভের অঙ্কটাও বেশ ভালো হওয়ায় শিক্ষিত ও চাকরিজীবীরা এতে ঝুঁকছেন। আরও বেশিসংখ্যক ভিন্ন পেশার মানুষ এতে অংশ নিক বলে চাইছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার ১ কোটি ১৬ লাখ গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষ কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্য দেশ থেকে আমদানি করা উট-দুম্বা এই হিসাবের বাইরে। চার লাখের বেশি মানুষ এবার কোরবানিকে সামনে রেখে পশু প্রস্তুত করেছেন।Eprothomalo অন্য পেশায় কাজ করলেও ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে বছরের কয়েক মাস পশু পালন করেন সুমন পারভেজ নামের এক তরুণ। লাভের অঙ্কটা প্রতিবছর বাড়ায় কোরবানিকে কেন্দ্র করে তাঁর পশুপালনও বাড়ছে। এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য সুমন পারভেজের মুঠোফোনে প্রথমে বার্তা পাঠানো হয় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে। গুগল টকব্যাকে বার্তাটি শুনে ফিরতি ফোন করেন সুমন পারভেজ। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় সরাসরি বার্তা পড়া সম্ভব হয় না তাঁর। টকব্যাক অ্যাপের ওপরই ভরসা করতে হয়। চোখে অস্ত্রোপচারের পর ৩০ শতাংশ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছেন। সেই দৃষ্টিসীমা দিয়ে অবয়ব ছাড়া কোনো কিছু স্পষ্ট দেখতে পারেন না তিনি। কমিউনিটি রেডিও ঝিনুকের জ্যেষ্ঠ অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে চাকরি করেন সুমন পারভেজ (২৪)। এটাই তাঁর মূল পেশা। তবে ঈদুল আজহার সময় তিনি মৌসুমি ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। ঈদকে সামনে রেখে আট-নয় মাস ধরে চলে তাঁর পশুপালন প্রস্তুতি। সে ক্ষেত্রে কোরবানির পশু হিসেবে শুধু ছাগল পালন করেন। ঝিনাইদহের সদর উপজেলার কালিচরণপুর ইউনিয়নের বড় মান্দারবাড়িয়া গ্রামে নিজ বাড়িতে পশু পালন করেন সুমন পারভেজ। বাবার নাম আয়নুদ্দিন জোয়ারদার। মায়ের নাম রিজিয়া বেগম। দুই ভাইয়ের মধ্যে সুমন ছোট। বড় ভাই মো. হিরণ কৃষিকাজ করেন। এবার কোরবানিকে ঘিরে প্রস্তুতি কেমন, তা জানতে চাইলে সুমন বলেন, ‘বেশির ভাগই বুকড।’ ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশন থেকে ব্রেইল পদ্ধতিতে কৃষি বিষয়ে ডিপ্লোমা করছেন সুমন পারভেজ। জানালেন, কোরবানির সময় ছাগল বিক্রির ধারণা ২০১৩ সালে তাঁর মাথায় প্রথম আসে। ওই সময় গ্রামের দুজনের কাছ থেকে আট হাজার টাকায় দুটো ছাগল কেনেন। আট মাস ধরে লালনপালনের পর ছাগল দুটি ৩২ হাজার টাকায় ঈদুল আজহায় বিক্রি করেন। আট মাসে একেকটি ছাগলের পেছনে তাঁর ব্যয় হয়েছিল সাত হাজার টাকা। সুমন পারভেজ জানালেন, এ বছর ঈদকে সামনে রেখে গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে গ্রামের বিভিন্নজনের কাছ থেকে ২০টি বাচ্চা ছাগল কিনে নেন। একেকটির দাম পড়েছিল পাঁচ হাজার টাকা করে। এই কয়েক মাসে লালনপালনে একেকটির পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় চার হাজার টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিটি ছাগলের পেছনে নয় হাজার টাকা ব্যয় করেছেন। ২০টির মধ্যে ১৮টি ইতিমধ্যে কেনার জন্য স্থানীয় ক্রেতারা ‘বুক’ করেছেন বলে জানালেন সুমন। পাঁচ-ছয় কেজি ওজনের বাচ্চা ছাগলগুলো এখন ১২ থেকে ২০ কেজি ওজনের হয়েছে। তিনি জানান, গড়ে একটি ছাগল এবার ১৭ হাজার টাকা করে দাম হেঁকেছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে তিনটি ছাগল ২০ হাজার টাকা দামে বিক্রি হবে বলে আশা করছেন। রাশেদুল হক (৪৫) ‘এম ও এল’ নামের একটি জাপানি শিপিং প্রতিষ্ঠানের কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। চার বছর ধরে কোরবানির পশু বিক্রি করছেন। কেরানীগঞ্জের হজরতপুরে বড়সড় খামারও গড়ে তুলেছেন। তবে টাকার চেয়ে শখই এতে যুক্ত হতে ভূমিকা রেখেছে বলে জানালেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘শখের বশেই কোরবানির জন্য পশু পালন শুরু করি। এখন এটা নেশা হয়ে গেছে।’ খামারে গরু দেখভালের জন্য কর্মী থাকলেও সপ্তাহের দু-তিন দিন তিনি নিজে শ্রম দেন বলে জানালেন। রাশেদুল হক বলেন, এবার কোরবানিকে সামনে রেখে ৩০টি দেশি জাতের গরু পালন করেছেন। এক বছর আগে গরুগুলো কিনেছেন। সঠিক খাবার ও পর্যাপ্ত যত্নে গরুগুলো বেশ বড় হয়েছে। বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত লোকজন গরুগুলো কিনতে চাইছেন। খামারে এসে গরুগুলো দেখেও যাচ্ছেন কেউ কেউ। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি খামারে ক্রেতার সঙ্গে ছিলেন। একেকটি গরু ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় বিক্রি করবেন বলে জানাবেন। দুই বছর ধরে এমন ব্যক্তি-উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে কোরবানির পশু কিনছেন বলে জানালেন আবদুল মালেক নামের এক ক্রেতা। কোরবানির দুদিন আগে এবার গরু কিনবেন বলে জানালেন। তিনি বলেন, গরু মোটাতাজাকরণে কৃত্রিম ওষুধ প্রয়োগ করা ঘটনা জানার পর হাট থেকে গরু কিনতে তাঁর ভয় হয়। পরিচিতজনদের মাধ্যমে এমন উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে এখন গরু কেনেন। তাঁর বিশ্বাস, এই বিক্রেতারা ‘ভেজাল গরু’ দেন না। ভিন্ন পেশার লোকজনের অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, লাভজনক হওয়ায় ভিন্ন পেশার অনেকেই কোরবানির সময় পশু ব্যবসায়ে ঝুঁকছেন। পাশের দেশ থেকে কোরবানির পশু আসা বন্ধ হওয়ার পর তিন বছর ধরে এ সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এটা উৎসাহব্যঞ্জক। এ ছাড়া অনেক খামারি (কমপক্ষে তিনটি গরু বা পাঁচটি ছাগল পালন করলে খামারি বলা হয়) ও কৃষক শুধু কোরবানিকে সামনে রেখে পশু পালন করেন। অনেক খামারি ১০০টি গরুও পালন করেন কোরবানিকে সামনে রেখে। ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় একটি গরু কিনে লালনপালন করে কোরবানির সময় ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকায় বিক্রি করেন। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে একটি পশু পালন করেন কোরবানির সময় বিক্রি করার জন্য। হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেন, ‘যশোরের এক ব্যক্তির কথা জানি। তিনি প্রতিবছর একটি “যমুনাপাড়ি” (ভারতীয় রামছাগল জাতের) ছাগল পালন করেন কোরবানির সময় বিক্রি করার জন্য। গত বছর এমন একটি ছাগল তিনি ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এবার ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করার আশা করছেন।’ তিনি জানান, এবার চার লাখের বেশি কৃষক, খামারি কোরবানির পশু পালনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা চাই, আরও বেশিসংখ্যক মানুষ কোরবানিকে সামনে রেখে পশুপালনে যুক্ত হোক। তাঁদের জন্য অধিদপ্তরের বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি রয়েছে। পশুগুলোর ভ্যাকসিন, ওষুধ প্রয়োগ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় আগ্রহী ব্যক্তিদের। কৃত্রিম উপায়ে স্টেরয়েড প্রয়োগ করে গরু মোটাতাজাকরণের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে। খামারি ও কৃষকদের বোঝানো হচ্ছে, এতে গরুর মাংস বাড়ে না। পানি বোঝাই হয়ে ওজন বেশি দেখায় এবং এর মাংস মানুষের জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি দাবি করেন, এই প্রচারে কাজ হয়েছে। এবার কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণ শূন্যের কোঠায়। হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেন, এবার কোরবানি হওয়া পশুর মাংস ও চামড়ার গুণগত মান ঠিক রাখতে আরও ব্যাপকভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে অধিদপ্তর। এ লক্ষ্যে পাঁচ হাজার কসাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
43A Railway Pde Lakemba, NSW 2195
email: editor@amardesh24.com
Copyright © 2016. Allright Reserved amardesh24.com