প্রকাশিতঃ শনিবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৭ ১১:০৩:৫৫ পূর্বাহ্ন
এ জীবনে কিছুই দেখা হলো না
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, বাজার ঘুরে দেখতে হবে। হাউজের সামনে দিয়ে স্লুইজগেট অভিমুখী খালে সারি সারি ট্রলার ভেড়ানো। কর্মচঞ্চল জায়গা, লোড-আনলোড করা হচ্ছে মাছ এবং অন্যান্য পণ্য। কিছু ট্রলারের সারাই ও রং-আলকাতরা লেপনের কাজ চলছে। দূর থেকে এক সারি ট্রলার দেখতে কি চমৎকারই না লাগে! এই হলো আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। নদী প্রধান এই দেশে যে কত রকম নৌকা আছে তার ঠিক নেই। একেক এলাকার একেক ধরনের নৌকা। এক এলাকার সাথে আরেক এলাকার নৌকার নকশা-কাঠামোতে ভিন্নতা রয়েছে। অঞ্চল ভেদে নৌকার গায়ে স্থানীয় সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সংস্কারের প্রতিচ্ছবিও ফুটে ওঠে।
ডিমের কুসুমের মতো সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ভাটার পর দিগন্তজোড়া জমিনে স্যাঁতস্যাতে আবরণ, তাতে কমলা রঙের অপূর্ব নকশা। আঁকাবাকা ও ঝিরিঝিরি নকশা চিত্রের স্পর্শ রেখে বিদায় হলো সূর্য। বাজারে যাওয়ার জন্য এটা অদর্শ সময়। আসার সময় বাজারের ভেতর দিয়েই আসতে হয়েছে। বেশ বড় বাজার। জমজমাট হয়ে ওঠার জন্য হাটবারের দরকার পড়ে না। স্থায়ী বাজার, প্রতিদিনের চিত্র প্রায় একই। একটা পাকা রাস্তা আর রাস্তার দুই পাশে দোকান। বেশিরভাগ দোকান টিন দিয়ে তৈরি। খাবার দোকানগুলোর ভেতরে-বাইরে মানুষের ভিড়। পেঁয়াজু, ডালপুরি আর জিলাপির সাথে গরুর দুধের গরম চা। আড্ডা জমেছে টেবিলে টেবিলে। সমুদ্রে এখন মাছ ধরা পরছে কম, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে এমন ধরনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাবলী তাদের আলোচনার মূল বিষয়। কখনও কখনও এসব বিষয় ছেড়ে আলোচনা পৌঁছে যায় জাতীয় রাজনীতির দিকে। সে থেকে আবার মৃদু তর্কবিতর্কও হচ্ছে। মড়মড়ে ভাজা ঝাল পেঁয়াজু দেখে লোভ হলো কিন্তু কোনো দোকানেই বসার মতো খালি জায়গা নেই। এক দোকান থেকে আরেক দোকান করছি, এমন সময় এক দোকান মালিক বিষয়টি লক্ষ্য করলেন। উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে একজনকে ডেকে বললেন, একটা টেবিল ফাঁকা করে উনাদের বসার ব্যবস্থা করে দে। সঙ্গে সঙ্গে একটা টেবিল ফাঁকা হলো বটে, তবে মালিকের ধমক আর আমাদের প্রবেশের কারণে আলোচনার সরগরম পরিবেশে যেন নীরবতা নেমে এলো। নীরবতা দেখে আন্দাজ করার উপায় নেই অল্পক্ষণ আগেও দুই কানে এখানে কিছু শোনা যাচ্ছিল না। এতে দোকন মালিক নিজেকে সার্থক ভাবলেও আমাদের জন্য ব্যাপারটা যারপর নেই বিব্রতকর হয়ে দাঁড়াল। মুহূর্তের মধ্যে এতগুলো মানুষের বাক স্বাধীনতা যেন হরণ করে নেয়া হলো।
ক্যাশ থেকে উঠে এসে টেবিল ভালোভাবে মুছে দিতে আদেশ করে বলা হলো, আমরা কী খাব তাড়াতাড়ি দিতে। এটা আরও বেশি বাড়াবাড়ি ঠেকল। এরই মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে সালাম দিল এক যুবক। পরিচয়- জাতীয় কোনো দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি। লোকের কাছ থেকে আমাদের ব্যাপারে জেনে ছুটে এসেছে। প্রথমেই তাকে আশ্বস্ত করলাম, আমরা কোনো প্রতিবেদক বা প্রতিনিধি নই। তাতে অবশ্য তাকে পরাস্ত করা গেল না। তিনি হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখালেন বাজারের বেশ খানিকটা। দোকানগুলোয় অতি নিম্নমানের বিস্কুট, চানাচুর ও অন্যান্য পণ্যে ঠাসা। তরিতরকারীর দোকানে বাতিল প্রায় শাকসবজি। বুঝতে বেগ পেতে হলো না স্থানীয়দের ক্রয় ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক অবস্থাটা আসলে কোন পর্যায়ে। পাকা রাস্তার শেষে বেশ কিছুটা হেঁটে গিয়ে উপস্থিত হলাম ঘাটে। রাতের অন্ধকারে দূরে দু’একটা ট্রলারের টিমটিমে আলো দেখা যায়। ভাঙ্গনে ঘাট চুরমার, আর একটা চাপর ভেঙে পরলেই শেষের দোকান ঘরটাও বিলীন হয়ে যাবে জলের বুকে। তারই সামনে পাতানো মাচাং। ট্রলার আসছে যাচ্ছে। এক মা সন্তানকে এগিয়ে দিতে এসেছে। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আছে কাঁথা-বালিশ। কয় দিনের জন্য সমুদ্রে মাঝ ধরতে যাচ্ছে কে জানে? সাধারণ কোনো বিদায় নয় অনিশ্চয়তার বিদায়। সমুদ্র থেকে আর ফিরবে কি না ঠিক নেই। পরম মমতায় সেলাই করা কাঁথা আর তেল চিটচিটে বালিশ সন্তানের হাতে দিয়ে মা দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত ট্রলারের বাতিটা অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। ওদিকে আমরা ইলিশ মাছের ঝোল দিযে পেট ভরে ভাত খেয়েই ঘুম। পরের দিনের যাত্রা এখান থেকে গলাচিপা।
ভোর ছয়টার আগে ‘সুইজগেট লঞ্চ ঘাট’-এ উপস্থিত হলাম। হ্যাঁ, সাইনবোর্ডে ঘাটের নামের বানান এমন করেই লেখা- সুইজগেট। ছোট লঞ্চ, নিচ তলায় কিছু মালামাল এবং মানুষ। উপর তলার ঘরটা স্বচ্ছ কাচে মোড়ানো, ২৫-৩০ জন যাত্রী বসার মতো। আসনে বসে জানালার কাচ সরিয়ে বাহিরটা চমৎকার দেখা যায়। রেলিং দেয়া সরু ব্যালকনিতে কেউ দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুকছে, কেউ পায়চারীরত। বোধহয় সাড়ে ছয়টায় ছাড়ল। গলাচিপায় যেতে কতক্ষণ লাগবে জানি না। একটু পর টিভিতে শাকিব খানের সিনেমা চালু হলো। থেকে থেকে ডিস্ক আটকে যাচ্ছে, তাতে যাত্রীদের বিরক্তি আর অধৈর্যের শেষ নেই। ওদিকে পরিচিত লোক পেয়ে অনেকেই গল্প জুড়ে দিয়েছে। এই বিস্তীর্ণ জলরাশি, এই খাল, এমনি করে মায়াবি প্রকৃতির পরত খুলে খুলে এগিয়ে চলছে ছোট্ট লঞ্চ। বিশ্বখ্যাত সুন্দরবনে আজও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে পত্র-পত্রিকার লেখনি এবং ছবিতে সুন্দরবনের যে চিত্র দেখেছি, এখানে যেন তার মিল খুঁজে পেলাম। দুই ধারে ঘন অরণ্যের দ্বীপ। এমন দ্বীপের সংখ্যা একটা নয় দুইটা নয়, অনেক। কবে কোন কালে জেগে ওঠা চরের বুকে শ্বাসমূলের গুচ্ছ বের করে দিয়েছে অজস্র বৃক্ষ। এতটাই গহীন যেন অনন্তকাল ধরে হেঁটে গেলেও ফুরাবে না পথ। বাইলাবুনিয়ার দিনটাকে এই ভ্রমণের শেষ আকর্ষণ বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখান থেকে এই লঞ্চ যাত্রা যে এতটা চমৎকার আর স্মরণীয় করে রাখার মতো হবে ধারণা করতে পারিনি।
ধীর গতির লঞ্চ, কখনওবা ভিড়ছে অরণ্যেরই কোনো ঘাটে। দুই তিনজন যাত্রী ওঠানামার পর আবার ছেড়ে দিচ্ছে। যেন সুন্দরবনেরই কোনো নদীতে ভাসছি। হয়তো এই অরণ্যের মাঝে লুকিয়ে আছে হরিণ, বানর অথবা হিংস্র বাঘ। পাখির কথা বলা বাহুল্য। মাছরাঙ্গা, চিল এবং অন্যান্য পাখির পাশাপাশি রয়েছে শতশত বক। গাছের ডাল অথবা কিনারের তৃণভূমিজুড়ে এদের অবাধ বিচরণ। অরণ্যের মাঝ থেকে বেরিয়ে এসেছে সরু দুই একটা খাড়ি, চমৎকার ছবির মতো বিলীন হয়েছে নদীর বুকে।
খাল, নদী পেরিয়ে এখন হারিয়ে গেছি সুবিশাল এক জলরাশির মাঝে। এরপরই বোধহয় গলাচিপার পানপট্টি ঘাট। পানপট্টি থেকে অটোরিকশায় পৌঁছলাম গলাচিপা লঞ্চঘাটে। লঞ্চের টিকিট কেটে খেতে ছুটলাম। লঞ্চ ছেড়ে দেবে বেলা দেড়টায়। উপকূলীয় এলাকায় বেড়াতে গেলে যে কারও ক্ষেত্রেই যে জিনিসটা প্রত্যাশায় থাকে তা হলো সমুদ্রের টাটকা মাছের স্বাদ নেয়া। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় লক্ষ করেছি ঘটে তার উল্টো। অর্থাৎ সমস্ত বাজার ঘুরে মাছের তরকারী দিয়ে ভাত খাওয়ার মতো কোনো দোকান মেলে না। খাবারের দোকানগুলোয় এ নিয়ে কথা বললে শুধু তাকিয়ে থাকে। বড় বাজার গলাচিপা। বোধহয় হাটবার হয়ে থাকবে। পথে মানুষের ভিড়। বাদাম এখানকার অন্যতম ফসল। নানান মানের বাদামের বস্তা কেন্দ্র করে ক্রেতাদের ভিড় লক্ষণীয়। মাছের তরকারীর খোঁজ করতে করতে পৌঁছে যাই বাজারের অন্য প্রান্তে। ওদিকে লঞ্চ ছেড়ে দেবার সময় হয়ে এলো প্রায়। অতএব, মাছ খাওয়ার ইচ্ছা চাপা দিয়ে যা পেলাম তাই খেয়ে ছুটলাম ঘাটের দিকে। পাশের মিষ্টি দোকানের তাক থেকে রসগোল্লা ও রসমালাই জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে। সুজিৎ ঘরি দেখে বলল, দাদা গোল্লা খাওয়ার সময়টা অন্তত পাওয়া যাবে। কমলা লেবুর সমান রসে টইটুম্বুর একেকটা রসগোল্লা। ভরপেট ভাত খাওয়ার পর দুই পদের মিষ্টি খেয়ে ঘাট পর্যন্ত যাওয়াটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল। এতটাই খাওয়া হয়েছে যেন গলা পর্যন্ত উঠে এসেছে, হা-করলে দেখা যাবে কী খেয়েছি!
লঞ্চ ছেড়ে দিল। বাংলার চিরাচরিত রূপ দেখতে দেখতে রাতের অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক। এঘাট-সেঘাট করে এগিয়ে চললাম ঢাকার দিকে, পৌঁছাব পরের দিন ভোরে। একেকটা ভ্রমণ মানে একেক ধরনের অভিজ্ঞতা। নতুন নগর-বন্দর, হাট-বাজার, প্রকৃতি ও মানুষ দেখা। ভ্রমণের সময় যখন ফুরিয়ে আসে হৃদর ঢেকে যায় এক গভীর বেদনায়- হায়, এ জীবনে কিছুই দেখা হলো না!