প্রকাশিতঃ শনিবার, ১৪ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:৪১:৪৬ পূর্বাহ্ন
বৈশাখে ব্যস্ত ছিলেন যারা...
ছাঁচ শিল্পীরা
মো. মতিউর রহমান, সাটুরিয়া (মানিকগঞ্জ) থেকে: সাটুরিয়ায় ব্যস্ত সময় পার করছেন ছাঁচ তৈরির শিল্পীরা। ডিসেম্বর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিভিন্ন মেলায় এ সাজ চাহিদা বেশি হওয়ায় রাতদিন কাজ করছে পরিবারের ছোট-বড় সবাই। বালিয়াটি ইউনিয়নের ভাটারা গ্রামে ৯ পরিবারের বণিক সদস্যরা পহেলা বৈশাখকে ঘিরে ছাঁচ তৈরিতে এ ব্যস্ত সময় পার করছে।
শুক্রবার ভাটারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ননী গোপাল বণিক গুড়ের বাতাসা তৈরি করছেন। সঙ্গে জোগান দিচ্ছেন স্ত্রী আলো রানী বণিক। চুলার মধ্যে আখের গুড় জাল করে একটি ছিদ্র পাত্র দিয়ে ঢেলে বড় বড় বাতাসা ছাঁচ তৈরি করছেন।
এ বাতাসা বিন্নি দিয়ে খেতে খুবই মজা বলে জানান। প্রায় ৪০ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত তিনি। ননী বণিক আরো জানান, খাঁটি আখের গুড় ছাড়া এ ছাঁচ বানানো যায় না। রাজশাহী থেকে ১ মণ খাঁটি গুড় কিনতে ২ হাজার ৭০০ টাকা লাগে। আর এক মণ গুড় দিয়ে ৩৫-৩৬ কেজি বাতাসা তৈরি হয়। মণে ১০০ টাকা লাভ করে বিভিন্ন জায়গায় পাইকারি বিক্রি মূল্যে ২৮ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। তবে এলাকার হাট-বাজারে আখের গুড়ে চিনি মেশানো থাকায় এ গুড় দিয়ে সাজ তৈরি করা যায় না বলে জানান তিনি।
বাসুদেব বণিক তিনি চিনি দিয়ে তৈরি করছেন মুকুট, হাতি, ঘোড়া, মাছ, নৌকা, পাখি ও লিচুসহ বিভিন্ন সাজ। চিনি জাল করে কাঠের ফ্রেমে ঢেলে দিয়ে ৫ মিনিট পর তৈরি হচ্ছে এসব সাঁচ। সে জানায়, এক মণ চিনিতে ১ মণ ছাঁচ হয়। এতে ২ হাজার ৭০০ টাকা খরচ হয়। ১০০ টাকা লাভে পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় ২৮ টাকা দরে। এসব ছাঁচ মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মধুপুর সখিপুর, গাজীপুর, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় পহেলা বৈশাখ চাহিদা থাকে। প্রতিদিন গড়ে এক মণ ছাঁচ তৈরি করা যায়। সে বাপ-দাদার আগের কাজ এখনো ধরে রেখেছেন বলে জানান। এ পেশা ছাড়া অন্য কোনো পেশা নেই তার। পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে এ সাঁচের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।
কথা হয়, শ্যামল বণিকের সঙ্গে। তিনি জানান, স্বাধীনতার আগে ও পরে এই ভাটারা গ্রামে ৭৮২ পরিবার বণিক ছিল। তারা সবাই ওই সময় তাঁতের কাজ করতেন। বেশির ভাগ বণিক ভারতে চলে যাওয়ায় এখন মাত্র ৯টি পরিবার ছাঁচের পেশা ধরে রেখেছেন। বিশেষ করে বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে বেশি ছাঁচ বিক্রি হয়ে থাকে। বছরের চার মাস পুরোদমে সাঁচের অর্ডার পাই। বাকি মাসগুলো বসে বসে খেতে হয়।
দেবেশ বণিক, নীলকান্ত বণিক, গোবিন্দ বণিক ও কমল বণিক জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমাদের এ ছাঁচ দেশের বাইরে রপ্তানি করা যেতে পারে। গ্যাসের ব্যবস্থা থাকলে এ ছাঁচ তৈরি করতে খরচ কম হতো। আমরা বিভিন্ন এনজিও থেকে টাকা নিয়ে এ সাঁচের ব্যবসা করে থাকি।
এ বিষয়ে বালিয়াটি ইউপি চেয়ারম্যান মো. রহুল আমীন বলেন, বাংলার কৃষ্টি কালচার এই বণিকরাই ধরে রেখেছেন। তারা বিভিন্ন মেলায় তাদের হাতের তৈরী ছাঁচ দিয়ে মেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। তাদের পৃষ্টপোষকতা করা গেলে আরো উন্নতি করতে পারবে বলে তিনি মনে করেন।
মৃৎশিল্পীরা
জাবেদ ইকবাল, রংপুর ও রেজাউল করিম পান্না, বদরগঞ্জ থেকে: আর কয়েকদিন পরেই পহেলা বৈশাখ। বৈশাখী মেলায় পুতুল, বাসন, হাড়িপাতিলসহ নানা তৈজসপত্রের পসরা সাজাতে শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত সময় পার করছেন পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। আর এ সামগ্রী তৈরি করতে আগে থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে কুমোর মাটি। এসব সামগ্রী তৈরি করে রোদে শুকিয়ে খড় দিয়ে ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে। অনেকে আবার পোড়ানোর পর তৈরি পণ্যগুলোতে নিপুণ হাতে রংতুলি দিয়ে রঙ করছেন। এমনিই চিত্র দেখা গেছে রংপুরের কয়েকটি পালপাড়ায়। রোববার রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর পালপাড়ায় ঘুরে দেখা গেছে, পাল সম্প্রদায়ে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার বংশ পরম্পরায় এ কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তারা সামনে বৈশাখী মেলায় মাটির তৈরি সামগ্রী তৈরি করতে বাড়ির সামনে মাটির স্তূপ করে রেখেছেন। ওই মাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ফুলদানি, ফুলের টব, হাড়িপাতিল, বাঘ, সিংহ, ব্যাঙ, বিভিন্ন সবজি, কলসসহ শিশুদের বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী। এসব সামগ্রী রোদে শুকানোর পর খড় দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে। পোড়ানোর পর রংতুলির আঁচড়ে রাঙ্গিয়ে তোলা হচ্ছে ওইসব সামগ্রী। সেখানে কথা হয় মৃৎশিল্পী রম্বিকা পাল ও জীবন কুমার পালের সঙ্গে। তারা বলেন, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন সামগ্রী বাজারে আসায় এ শিল্পের কদর আগের মতো নেই। এ পরও অনেকে বাপ-দাদার এ পেশাকে আকড়ে ধরে রেখেছে। তারা আরো বলেন, কয়েকদিন পরেই পহেলা বৈশাখ। বৈশাখী মেলায় এসব মাটির পণ্যের চাহিদা অনেক বেশি থাকে। এ কারণে বছরের এ সময় আমাদের দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। একই কথা বলেন, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার চওড়াবাজার পালপাড়া গ্রামের মৃৎশিল্পী সুখদেব চন্দ্র পাল ও পুতুল চন্দ্র পাল।
মাটির তৈরি এসব সামগ্রী বিক্রেতা হানিফুল ইসলাম বলেন, আগের দিনে এসব জিনিসপত্রের অনেক চাহিদা ছিল। এখন এসব জিনিসপত্র মানুষ আর কিনতে চায় না। সবাই শুধু প্লাস্টিকসহ আধুনিক জিনিস চায়। এ কারণে এ পেশা ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ক্রেতা আবুল হোসেন জানান, এক সময় মাটির তৈরি এসব পণ্য সংসারের অনেক কাজে লাগতো। কিন্তু প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন আধুনিক জিনিসপত্র বের হওয়ায় এখন আর এসব পণ্যের চাহিদা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর বিভাগে এক সময়ে পাল সম্প্রদায়ের লোকজন তৈজস জিনিসপত্র তৈরি করে হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা অর্চনা, বিভিন্ন মেলা, বারুনী ও হাট বাজারে বিক্রি করতো। কিন্তু প্লাস্টিকসহ আধুনিক বিভিন্ন সামগ্রী বাজারে আসায় এ শিল্প এখন মৃত প্রায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃৎশিল্পীদের প্রশিক্ষণ ও সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে এ শিল্প একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বৈশাখী মেলাকে সামনে রেখে টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ধনবাড়ীতে নিজেদের মাটির তৈরি জিনিসপত্রের পসরা সাজাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরা। মেলার চাহিদা মেটাতে পৌর শহরের সেনবাড়ী পালপাড়া গ্রামের মৃৎশিল্পীরা তাদের মাটির তৈরি জিনিসপত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করতে পরিবারের সবাই দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। তারা মনের মাধুরী মিশিয়ে বিভিন্ন মাটির তৈরি খেলনার আকৃতি দিচ্ছেন।
সরজমিন পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, মৃৎশিল্পীরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের হাড়ি-পাতিল, কেউবা বিভিন্ন পশু-পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণীর আকৃতি তৈরিতে ব্যস্ত, কেউবা তুলি নিয়ে মনের মাধুরী দিয়ে রং দিচ্ছে। অনেকেই আবার কাঁচা মাটির খেলনাগুলো রোদে শুকাচ্ছে।
কথা হয় ধনবাড়ী উপজেলার মৃৎশিল্পী তুলসী পাল, উজ্জল পাল, নির্মল পাল, বাসনা পাল, অর্চনা পাল, রেখা পাল, বাণী পাল ও সন্ধ্যা রানী পালের সঙ্গে। তারা জানান- মাটির তৈরি এসব জিনিসপত্র ডিজাইন করা, রং করা, রোদে শুকানো, আগুনে পোড়ানোসহ বিভিন্ন কাজ করতে হচ্ছে।
পালপাড়ার গোবিন্দ পাল জানান- আমরা এ বছর হরিণ, গরু, ঘোড়া, হাতি, খরগোশ, উটপাখি, হাঁস, বক, টিয়া, গন্ডারসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর আকৃতি তৈরি করেছি। আমাদের উৎপাদিত মাটির পণ্যগুলো বিভিন্ন মার্কেটে সরববাহ করা হবে। একই এলাকার বয়োবৃদ্ধ সুমতি রানী পাল বলেন- আমরা এ বছর সোনালী রংয়ের পাতিল, ঢোল, মগ, কারি বল, জগ, লবণ বাটি, শালকি (বসনা), তরকারির বাটি তৈরি করেছি। এ ছাড়াও তৈরি করা হয়েছে মাটির সাধারণ ফুলের টব। আধুনিক নানা ধরনের খেলনাও। রাসায়নিক কোনো পদার্থ ছাড়াই তৈরি করা হয় মাটির এসব পণ্য। পণ্যের রং করা হয় প্রাকৃতিক উপায়ে। আর এসব রং সংগ্রহ করা হয় নানা ধরনের গাছের কষ থেকে। যাতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না।