স্ত্রীর মাধ্যমে স্বামীর ওপর সহিংস হামলার ঘটনা যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আগে বিচ্ছিন্নভাবে এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটলেও সম্প্রতি পারিবারিক কলহের শিকার নারীদের তাদের স্বামীর ওপর সহিংস হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে একের অধিক বিয়ে, পরকীয়া, অর্থনৈতিক কারণসহ বিভিন্ন দাম্পত্য কলহের জন্য নারীরা স্বামীদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন। তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, নির্যাতনের শিকার নারীরা স্বাভাবিক ও সুস্থ উপায়ে নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে পারেন।
চরম পৈশাচিক উপায়ে স্বামীদের ওপর সহিংস আচরণের মাধ্যমে তারা পরিবার ও সমাজকে ধ্বংস করছেন। এর ফলে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস কমে আসছে আর ভুক্তভোগী পরিবারের সন্তানদের এর নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে বিপর্যয় ডেকে না আনে এজন্য গণমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করাতে হবে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় নির্যাতিত নারীদের সহিংস হয়ে ওঠার বিষয়টি সামনে এসেছে। ঢাকার ধামরাইয়ে কিছুদিন আগে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে পোশাকশ্রমিক মর্জিনা বেগম (২৭) তার স্বামী সুমনের (৩২) গোপনাঙ্গ কেটে নেন। স্ত্রী পরকীয়া করছেন- এমন অভিযোগে তার মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর আপত্তি করায় মর্জিনা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে এ কাজ করেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটান মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার রণজিৎ হোসেনের (৪৭) স্ত্রী মনোয়ারা। ১৯ জানুয়ারি রণজিতের দ্বিতীয় স্ত্রী মনোয়ারা স্বামীর চার বিয়ের ঘটনা মেনে নিতে না পেরে স্বামীর ওপর সহিংস আক্রমণ করেন। নাটোরের গুরুদাসপুরে দাম্পত্য কলহের জেরে কাবিল বিশ্বাসের (২৫) স্ত্রী রুমা খাতুন স্বামীর গোপনাঙ্গ কেটে নিলে তার মৃত্যু হয়।
রুমা অভিযোগ করেন, স্বামীর অতিরিক্ত যৌন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এ ঘটনা ঘটান। মুন্সীগঞ্জে কিছুদিন আগে নিজ পিতার লালসা থেকে কন্যাকে রক্ষা করতে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে এক নারী তার স্বামীর যৌনাঙ্গ কেটে দেন। দীর্ঘদিনের পারিবারিক কলহ থেকে গাজীপুরের শ্রীপুরে রফিকুল ইসলাম তার স্ত্রী জীবন্নাহারের চাকরির বেতনের টাকা নিজের কাছে রাখতে চাইলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর একপর্যায়ে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেন রফিক। পরে ইট দিয়ে মেরে ও গামছা দিয়ে শ্বাসরোধ করে স্বামীকে হত্যা করেন। শেষে স্বামীর মৃতদেহ বঁটি দিয়ে কেটে ছয় টুকরা করেন। পারিবারিক কলহের কারণে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ থানার দেওয়ানপুর গ্রামের সনাতন মজুমদার প্রকাশ সনকে (৪৫) তার স্ত্রী লাকী মজুমদার (৩০) ঘুমের মধ্যে প্রথমে কাঠ দিয়ে আঘাত করেন, পরে গলায় করাত চালিয়ে হত্যা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেন, ‘বিকৃত রুচির মানুষই এ ধরনের ঘটনা ঘটায়। কোনো নির্যাতিত নারী এ ধরনের পৈশাচিক ঘটনা না ঘটিয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে পারেন। যেহেতু আমাদের সমাজ এক ধরনের “ট্রানজিশনাল পিরিয়ড”-এর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। আবার আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো পরিবার চুরমার করার বিভিন্ন সিরিয়াল দেখাচ্ছে। আবার বিশ্বায়নের এ যুগে মানুষ ক্রমান্বয়ে ভোগবাদী সমাজের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এজন্য তারা যে কোনো ধরনের খারাপ কাজ করতেও রাজি আছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে সম্পর্ক সব সময় মধুর হবে এমনটি নয়। কিন্তু এখন দম্পতিদের মধ্যে সহনশীলতার বেশ অভাব। এর ফলে তাদের অনেকের মধ্যে কুৎসিত ও পৈশাচিক প্রবৃত্তির জন্ম হচ্ছে। ’ বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘স্বামীর ওপর স্ত্রীর সহিংস আক্রমণের ঘটনা আগে কদাচিৎ দেখা যেত। কিন্তু এখন আকাশ সংস্কৃতির কারণে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলে বিশেষ করে ভারতীয় বিভিন্ন ক্রাইম সিরিজ থেকে একজন নির্যাতিত নারী তার স্বামীকে কীভাবে হত্যা করা যায় তা শিখছেন। এসব সিরিয়ালের প্রচারিত অনুষ্ঠান থেকে মানুষের মধ্যে অনৈতিক চিন্তা-ভাবনাগুলো প্রভাব বিস্তার করছে। আবার বিবাহিত নারীরা আগে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল থাকলেও এখন নিজেরাই আত্মনির্ভরশীল। ফলে স্বামী-স্ত্রীর সহ্যক্ষমতা কমে গেছে। এমনকি মানুষের নৈতিক মূল্যবোধও শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আর এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের সন্তানদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে।