ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতে দুটি মাইলফলকের সামনে মাশরাফি বিন মুর্তজা।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শুক্রবার টস করতে নামলেই মাশরাফি দুটি রেকর্ডে নিজের নাম সবার ওপরে তুলবেন। ২০১টি ওয়ানডে খেলা মাশরাফি শুক্রবার বাংলাদেশের হয়ে ২০০তম ওয়ানডে খেলবেন। ২০০৭ সালে এশিয়া একাদশের হয়ে দুটি ওয়ানডে খেলেছিলেন নড়াইল এক্সপ্রেস।
বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেওয়ার রেকর্ডও গড়বেন মাশরাফি। ৬৯ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে মাশরাফি আগের ম্যাচেই হাবিবুল বাশার সুমনের পাশে বসেছেন। এবার পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষা।
২০১ ওয়ানডে খেলা এবং ৬৯টিতে নেতৃত্ব মাশরাফির নামের পাশে। আছে আরো অনেক অর্জন। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট মাশরাফির। সবচেয়ে বেশি জয় তো এসেছে তার নেতৃত্বেই। এসব শুধুই সংখ্যা। মাশরাফির গভীরতা আরো বেশি, আরো সমৃদ্ধ। বদলে যাওয়া যে বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে গত চার বছর ধরে, সেই বাংলাদেশের মূল কারিগর তো মাশরাফিই।
অথচ তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারত ২০১১ বিশ্বকাপের সময়ই। বিশ্বকাপ দলে সুযোগ না পেয়ে চোখে জল নিয়ে মিরপুর ছেড়েছিলেন। কিন্তু ওই সময়ে হার মানেননি। ফিরে এসেছেন। স্বরূপে পারফর্ম করেছেন। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় দফায় অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন ‘নতুন’ ক্রিকেট দল। যে দলটি ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে, প্রতিপক্ষকে বলে-কয়ে হারাতে পারে, জিততে পারে যেকোনো কন্ডিশনে, ওড়াতে পারে বিজয়ের ঝান্ডা।
চোট যেমন মাশরাফির পুরো ক্যারিয়ার নিয়ন্ত্রণ করেছে, ঠিক তেমনি তার অধিনায়কত্বের ক্যারিয়ারও চোটজর্জর! প্রথম দফায় ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের প্রথম টেস্টেই চোট। এরপর আর টেস্টে ফেরা হয়নি তার। ২০১০ সালে ওয়ানডের দায়িত্ব পাওয়ার পর ইংল্যান্ড সফরে বাংলাদেশকে প্রথম জয় উপহার দেন মাশরাফি। এরপর ঢাকায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাশরাফির নেতৃত্বে জয় পায় বাংলাদেশ। কিন্তু চোটের কারণে ছিটকে যান সিরিজের প্রথম ম্যাচে। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে আবার চোট। বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নভঙ্গের, পাশাপাশি অধিনায়কত্বে হাতবদল। প্রথম দফায় বাংলাদেশকে ৭ ম্যাচে ৩টিতে জয় উপহার দেন নড়াইল এক্সপ্রেস।
দ্বিতীয় দফায় মাশরাফি যখন আবার অধিনায়কের দায়িত্ব পান তখন বাংলাদেশের অবস্থা কতটা করুণ, তা একটা পরিসংখ্যানে স্পষ্ট হবে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ খেলেছে মোট ৭৮ ওয়ানডে। জয়-পরাজয় সমান ৩৭টি করে। মাশরাফি দলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর। এর আগে বছরের ১৩টি ওয়ানডের ১২টিতে হার, একটিতে ফল আসেনি। মাশরাফি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই জিম্বাবুয়েকে ৫-০ তে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। এরপর বিশ্বকাপের নজরকাড়া পারফরম্যান্সে উন্নতির পথে যাত্রা শুরু। সেই যাত্রা এখনো অব্যাহত আছে। সবই ওই স্বপ্নের কারিগরের হাত ধরে।
এই সময়ে ৬৫ ওয়ানডেতে ৩৭ জয় ও ২৫ হার। জয়ের সংখ্যায় বাংলাদেশ খুব পিছিয়েও নেই, পাকিস্তানের ৭৯ ম্যাচে ৩৯, অস্ট্রেলিয়ার ৭৮ ম্যাচে ৪১, দক্ষিণ আফ্রিকার ৭৯ ম্যাচে ৪৮। আর নিউজিল্যান্ড ৮৮ ম্যাচে ৫৩, ভারত ৮৫ ম্যাচে ৫৫ এবং ইংল্যান্ড ৯৫ ম্যাচে ৫৭ জয় পেয়েছে। বাংলাদেশের থেকে পিছিয়ে শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তান।
তাইতো অধিনায়ক মাশরাফি সবাইকে ছাড়িয়ে অন্য উচ্চতায়। কিন্তু সাদামাটা মাশরাফি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেই খুশি। গর্বিত লাল-সবুজের জার্সি গায়ে দলের ১১ জনে থাকতে পেরে। তবে স্বপ্নের কারিগর দায়িত্ব নেওয়ার পর অতসব ভাবেননি। দলকে কোথায় নিয়ে যাবেন, কতটুকু সাফল্য এনে দেবেন, সে চিন্তা কখনো করেননি। বড় কোনো স্বপ্ন দেখাননি।
অধিনায়কত্ব নিয়ে সিলেটে বৃহস্পতিবার অনুশীলন শুরুর আগে খোলামেলা কথা বলেছেন মাশরাফি, ‘দুবার অধিনায়কত্ব পেয়েছি। শুরুতে এক-দুই-তিন বা চার-পাঁচ ম্যাচ পর (সাত ম্যাচ) ইনজুরিতে পড়ে গিয়েছি। ইনজুরিতে পড়ে দল থেকে বাদ হয়েছি। দীর্ঘ সময় বাইরে ছিলাম। টেস্টে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অধিনায়কত্ব পাই তখন অনেক আশা ছিল। টেস্ট ক্রিকেটে তখন পুরো ছন্দে খেলছি। ২০০৮ সালে আমি খুব ভালো ফর্মেও ছিলাম। লাল বলে তাই তখন অনেক আশা ছিল।’
‘পরেরবার আবার একই পরিস্থিতি। অধিনায়কত্ব আমার ইস্যুতে ছিল না। আমার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলা। ২০১৪ সালে যখন আবার দায়িত্ব পাই তখন নিজেকে নিয়ে ভবিষ্যতে চিন্তা করা বা খেলোয়াড় হিসেবে নিজে কোনোকিছু সেট করতাম না। চলতে থাকুক যতদিন চলতে থাকে– এভাবেই চিন্তা করেছি। এভাবে করতে করতে প্রায় চার বছর হতে যাচ্ছে।’
‘এটা (বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে নেতৃত্ব দেওয়া) আমার এবং আমার পরিবারের জন্য খুব গর্বের। দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব করতে পেরেছি। অবশ্যই এটা ভালো অনুভূতি। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই দলে ১১ জন যারা পারফরমার আছে…সেই দলের সদস্য হয়ে থাকাও কিন্তু বিরাট গর্বের ব্যাপার। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের একজন সদস্য হয়ে থাকা অনেক গর্বের।’
৬৯ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে ৩৯টিতে জিতিয়েছেন মাশরাফি। এটা শুধুমাত্রই সংখ্যা। দলের বর্তমান সাফল্যের জন্য মাশরাফির অবদান আরো বড়, আরো বিস্তৃত।