বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল, ১৪৪৫ | ০২:৫৫ অপরাহ্ন (GMT)
ব্রেকিং নিউজ :
X
শিরোনাম :
  • নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে আ.লীগ: কাদের
  • ইসি নয়, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে হার্ডলাইনে যাবে বিএনপি


মঙ্গলবার, ০৯ অক্টোবর ২০১৮ ০২:০৪:০৬ পূর্বাহ্ন Zoom In Zoom Out No icon

দেশের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা

নির্বাচন নিয়ে সরকারি মহলে যে এক নতুন তৎপরতা শুরু হয়েছে এটা সংবাদপত্র রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে। ৬ অক্টোবর সিলেটে উন্নয়ন মেলায় নির্বাচন কমিশনের স্টল পরিদর্শনকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, নির্বাচন এ বছর ডিসেম্বর মাসে হবে এমন কোনো কথা তারা কোনো সময়ে বলেননি। তিনি বলেন, নির্বাচন তফশিল ঘোষণার কোনো তারিখও তারা ঠিক করেননি (Daily Star, 06.10.2018)। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার একথা বললেও তিনি এ বছর ৭ আগস্ট এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বলেছিলেন, নির্বাচন খুব সম্ভবত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হবে (Daily Star, 06.10.2018)। তার এই বক্তব্যের পর থেকেই ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা সবাই ধরে নেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ প্রসঙ্গে বলছেন, ডিসেম্বর নির্বাচন হবে এটা লোকের ধরে নেয়া কথা, তাদের কথা নয়! নির্বাচন কমিশনের সচিব বলেছেন, পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা ৩০ অক্টোবরের পর হতে পারে (Daily Star, 06.10.2018)। নির্বাচনের তারিখ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের এই বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ৭ অক্টোবর তাদের গণসংযোগ কর্মসূচির শেষদিনে এক সমাবেশে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখের আগে যে কোনো দিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে পারে। তবে এটা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার’ (যুগান্তর, ০৮.১০.২০১৮)। বেশ ভালো কথা। নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক আছে। এবং নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্দেশমতোই কাজ করছে। যেখানে নির্বাচন হওয়ার কথা ডিসেম্বর মাসে সেখানে এখন বলা হচ্ছে, ২৭ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। অর্থাৎ নির্বাচন হবে আরও পরে। এটা যে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ারই এক চক্রান্ত এতে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যেহেতু আওয়ামী লীগ ও সরকারের মুখপাত্র হিসেবেই আজকাল সব কথা বলছেন, তাতে এটা ধরে নেয়া ভুল হবে না যে, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের তারিখ বিষয়ে তার নতুন ঘোষণা দিয়েছেন! এই নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের সময় কতখানি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে সেটা এর থেকে বোঝার অসুবিধা নেই। এর থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে আবার জনগণ ও ভোটারদের বুড়ো আঙুল দেখিয়েই নির্বাচন করার চিন্তাভাবনা করছে। এর সঙ্গে আছে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী, যারা নিমকহারাম নয়। কাজেই তারাও এখন বলছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরাট জয় একেবারে অবধারিত। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে!! প্রধানমন্ত্রী তার আমেরিকা সফর শেষে দেশে ফিরে বলেছেন, বিশ্বনেতারা তাকেই আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। যদি তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েই থাকে এবং বিশ্বনেতারাও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারকে আবার ফেরত দেখতে চায়, তাহলে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দরকার হয় কেন? যারা এভাবে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়, পিছিয়ে দিয়ে নিজেদের সরকারের মেয়াদ যতটা সম্ভব বাড়াতে চায়, তারা কি প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনে জয় সম্পর্কে কখনও নিশ্চিত হতে পারে? আসলে নির্বাচন নিয়ে সরকারি দলের মধ্যে, সমগ্র আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে একটা আতঙ্কের ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এই আতঙ্ক যতই তাদের বাড়ছে ততই তাদের কথাবার্তা লাগামছাড়া হচ্ছে, তারা নিজেদের কথাবার্তার খেই হারিয়ে ফেলছে। তাদের এখন একমাত্র ভরসা নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ। কিন্তু জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হলে তাদেরকেও ঠিকমতো কাজে লাগাতে অসুবিধা হয়, বিশেষ করে পুলিশকে। এদিক দিয়ে তাদের অবস্থা ২০১৪ সালের মতো নেই। তখন হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশন ও পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে বিরোধী দলগুলোর পক্ষে কোনো প্রতিরোধ সম্ভব ছিল না। কাজেই সেই নির্বাচন ছিল একতরফা। তাতে যে শুধু বিরোধী দলগুলোর কোনো ভূমিকা ছিল না তা-ই নয়, জনগণেরও কোনো ভূমিকা ছিল না। ভোটারদেরও বিশেষ ভূমিকা ছিল না। কাজেই ১৫৩টি আসনে কোনো ভোট ছাড়াই আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। আওয়ামী লীগ ও তাদের বুদ্ধিজীবী, স্তাবক ও গুণকীর্তনকারীরা ধরেই নিয়েছে যে, চাতুর্যের দ্বারা আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি করে সফল হবে। কিন্তু তার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের সাম্প্রতিক দ্বিতীয় মেয়াদে তারা জনগণের ওপর যে নির্যাতন করেছে, পুলিশি দমনপীড়ন, সভা-সমিতি-মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা যেভাবে চাপিয়ে রেখেছে, দেশকে যেভাবে পুলিশ নিয়ন্ত্রিত দেশে পরিণত করেছে, সংবাদপত্রের ওপর এবং পুরো প্রচারমাধ্যমের ওপর যেভাবে খবরদারি করেছে এবং লুটপাটকারী-চোর-দুর্নীতিবাজদের যেভাবে দেশের জনগণের সম্পদ আহরণ করতে দিয়েছে, তাতে তাদের অবস্থা ২০১৪ সালের থেকে অনেক বেশি খারাপ হয়েছে। এর ফলে দেশের ব্যাপক জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তার শীর্ষ থেকে নিু পর্যায়ের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, নির্বাচনে কারচুপি করলে সে ক্ষোভ ক্রোধে পরিণত হবে। অন্যদিক দিয়েও পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য আছে। ২০১৪ সালে জনগণের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ থাকলেও তাকে রাজনৈতিকভাবে ধারণ করার মতো সংগঠিত কোনো শক্তি থাকেনি। বিএনপি তার নানারকম অপকর্ম, জ্বালাও-পোড়াও নীতির দ্বারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হয়েছিল এবং অন্য কোনো দলও সক্রিয় থাকেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতির মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। একদিকে জনগণের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও ক্রোধ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি এই ক্ষোভ ও ক্রোধকে ধারণ করার মতো সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিও তৈরি হয়েছে। দুর্বলতা সত্ত্বেও বিএনপি ২০১৪ সালের তুলনায় এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। ২০১৪ সালে তাদের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছিল। এখন তাদের জনপ্রিয়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারা যে সমাবেশ করেছে তার ধারেকাছে কোনো কিছু করা বিএনপির পক্ষে ২০১৪ সালে সম্ভব ছিল না। এছাড়া শাসক শ্রেণীর ক্ষমতাবহির্ভূত সমগ্র অংশই এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। তারা একমঞ্চে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় এসে দাঁড়াচ্ছে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য কোনো সুখের বা স্বস্তির ব্যাপার নয়, উপরন্তু আতঙ্কের ব্যাপার। এবং তারা আতঙ্কিতও হয়েছে, যার প্রতিফলন তাদের নানা এলোপাতাড়ি বক্তব্যের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। তাদের সাধারণ সম্পাদকের দৈনন্দিন কথাবার্তার মধ্যে ক্ষিপ্ততার পরিচয়ও যথেষ্ট। এসব কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। যে বিরোধী দল ও গ্রুপগুলো এখন একমঞ্চে দাঁড়ানোর জন্য তৈরি হয়েছে, তাদের মধ্যে নীতি ও মতামতের অনেক পার্থক্য। কোনো সাধারণ অবস্থায় তাদের এভাবে একমঞ্চে দাঁড়িয়ে সরকার প্রতিরোধের কথা নয়। কিন্তু এখন সে ধরনের পরিস্থিতিরই উদ্ভব হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ থেকে নিয়ে সব ধরনের বিরোধী দলই এখন তাদের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য মরিয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কথিত বিজ্ঞ নেতারা আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফেরত আসুক এটা চাইলেও নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ফেরত আসা আর সম্ভব নয়। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, এ কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার এখন নির্বাচনকে ভূতের মতো ভয় করছে এবং নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের সাহায্যে সেই ভূত তাড়ানোর চিন্তা করছে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা দল যা চায় সেটা সব সময়ে হয় না। কী হবে সেটা পরিস্থিতির দ্বারাই নির্ধারণ হয় এবং এখনকার পরিস্থিতি যে আওয়ামী লীগের অনুকূল নয়, এটা বলাই বাহুল্য। নির্বাচনের আগে ভীত হয়ে আওয়ামী লীগ অনেক কাণ্ড করছে। তার মধ্যে একটা হল- হাজার হাজার বিরোধীদলীয়, বিশেষত বিএনপির, লোকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। এ ধরনের মিথ্যা মামলা তারা সব সময়েই দিয়ে আসছে। কিন্তু এখন এর মাত্রা একেবারে ছাড়িয়ে গেছে। এক হিসাবে বলা চলে, এই মামলার সংখ্যা তাদের আতঙ্কগ্রস্ততার সঙ্গে তাল রেখেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যা স্বাভাবিক তা হল, নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় লোকদের অনেককে আটক অবস্থা থেকে ছেড়ে দেয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্যরকম। বিরোধী দল যাতে অসুবিধায় পড়ে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার জন্য নির্বাচনের আগে তারা আরও বেশি করে বিরোধীদলীয় লোকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করছে। দেশের যে পরিস্থিতি এখন দেখা যাচ্ছে, তাতে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মতো একতরফা নির্বাচনের চেষ্টা যদি করে, তাহলে তার পরিণতি তাদের জন্য ভালো হবে না এবং দেশের অবস্থাও বিপর্যস্ত হবে। কিন্তু তারা এই পথ ধরেই অগ্রসর হচ্ছে। আগে তারা বিরোধী পক্ষের দাবির মুখে বলেছিল, নির্বাচনকালে নতুন সরকার গঠিত হবে। এখন তারা বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এর থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, তারা ২০১৪ সালের খেলাই আবার খেলতে চাইছে আগামী নির্বাচনের সময়। আমরা গণক ঠাকুর নই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে, পরিস্থিতি সে রকম হলে দেশের অবস্থা টালমাটাল হয়ে জনগণের অবস্থাও বড় আকারে বিপর্যস্ত হবে।





আরো খবর