বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল, ১৪৪৫ | ০১:৩৫ অপরাহ্ন (GMT)
ব্রেকিং নিউজ :
X
শিরোনাম :
  • নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে আ.লীগ: কাদের
  • ইসি নয়, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে হার্ডলাইনে যাবে বিএনপি


শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৩৫:২৮ পূর্বাহ্ন Zoom In Zoom Out No icon

সিন্ডিকেটের কবলে রোজার চার পণ্য

রমজান আসার আগেই রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নিত্যপণ্যের বাজার সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। বাণিজ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে ডাল, ছোলা, চিনি ও পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে ডালের দাম প্রায় ৪৫ শতাংশ, ছোলার দাম প্রায় ১৪ শতাংশ, চিনির দাম ৪ শতাংশ ও পেঁয়াজের দাম ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। রোজার অনুষঙ্গ এ চার পণ্যের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে আড়তদাররা আন্তর্জাতিক বাজারকে দায়ী করছেন। তবে, খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রোজা সামনে রেখে আড়তদাররা পণ্যগুলো মজুদ করায় কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে এবং এ কারণে দাম বাড়ছে। এক্ষেত্রে শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দাবি বাজার বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ ভোক্তাদের। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, চাহিদার তুলনায় নিত্যপণ্যের মজুদ অনেক বেশি। তাই এবারের রমজানে পণ্যের দাম বাড়বে না। পণ্য আনা-নেয়ার রাস্তায় যেন কোনো ধরনের চাঁদাবাজি না হয় সে জন্য সংশ্লিষ্টদের শিগগিরই চিঠি দেয়া হবে। এ ছাড়া মনিটরিংয়ের সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রমজানকে কেন্দ্র করে সুযোগ নিচ্ছে কিনা সে বিষয়টি আমরা নজরে রাখছি। সার্বিকভাবে আমরা পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। রমজানকে পুঁজি করে নিত্যপণ্যের দাম যাতে না বাড়ে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা আছে। শুক্রবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারি ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক। খাতুনগঞ্জের শাহ আমানত ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. মহিউদ্দিন জানান, বাজারে রোজার পণ্যগুলোর কোনো সংকট নেই। মাঝে-মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ে। তখন ব্যবসায়ীরা সেই দরের সঙ্গে সমন্বয় করেন। এতে জিনিসপত্রের দাম সাময়িকভাবে বেড়ে যায়। তবে ব্যবসায়ীদের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয় বাজার নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সংস্থা। তারা বলছে, একজন ব্যবসায়ী আজকে যে পণ্য বাজারে তুলেছেন সেটা ৪-৫ মাস আগে এলসি খুলেছেন। সেই হিসাবে তার পণ্যের দাম আজকের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কোনো সুযোগ নেই। এটা একটি অসাধুতা। চট্টগ্রামের বাজারে ছোলা ও ডালের দাম দু’দিনের ব্যবধানে মণপ্রতি বেড়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। পাইকারি বাজারে মিয়ানমারের উন্নতমানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি দুই হাজার ৪৫০ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা। কয়েকদিন আগে তা ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ২৫০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার উন্নতমানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকা দরে। এ ছোলা দু’দিন আগে ২ হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মাঝারি মানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৪৫০ টাকা দরে। ক’দিন আগে তা বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ২০০ টাকায়। ২ হাজার ১০০ টাকার ছোলা এখন ২ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই ভাবে বাড়ানো হয়েছে ডালের দাম। শুক্রবার মসুর ডাল কেজিপ্রতি ৯৩ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। দু’দিন আগে তা ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। মোটা মসুর ডালের দাম কেজিতে সাত টাকা বেড়ে ৮৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দু’দিন আগে প্রতিমণ ডাল বিক্রি হয়েছিল ৩ হাজার ১০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। এখন মণপ্রতি ডাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪৮০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা দরে। খেসারির ডাল প্রতি কেজি ৩৬ টাকা থেকে বেড়ে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাকতাই-খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ট্যারিফ কমিশন ও সরকারি হিসাবে দেশে প্রতি মাসে ছোলার চাহিদা গড়ে ১২ হাজার টন। বছরের চাহিদা ১ লাখ ৪৪ হাজার টন। শুধু রমজানে চাহিদা ৮০ হাজার টন। ইতিমধ্যেই দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে ছোলা আমদানি করা হয়েছে। এর পরিমাণ প্রায় ৯০ হাজার টন। সেই হিসাবে কোনো সংকট নেই। এরপরও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। তারা আরও জানান, কয়েকজন আমদানিকারক দু’দিনে বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ ছোলা কিনে নিয়েছেন। এতে বাজারে ছোলার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হয়েছে। দুই বছর ধরে আমদানিকারকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছোলা আমদানি করে আসছে। এতে কয়েক বছর ধরে দেশে ছোলার সংকট থাকছে না। বরং উদ্বৃত্ত থাকছে। চলতি বছর প্রচুর পরিমাণে ছোলা আমদানি করা হয়েছে। স্থানীয় আমদানিকারক ছাড়াও দেশের কয়েকটি শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ ছোলা আমদানি করেছে। এসব ছোলা ইতিমধ্যেই বাজারে প্রবেশ করেছে। আরও কয়েকটি জাহাজে ছোলা আসার অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া গত রমজানের জন্য আমদানি করা ছোলার মজুদ রয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে বাড়ছে এসব ভোগ্যপণ্যের দাম। পাইকারি পর্যায়ের ক্রেতারা নগরীর বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চাকতাই-খাতুনগঞ্জ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে খুচরা বিক্রি করেন। তারা জানান, রমজানকে সামনে রেখে চাকতাই-খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা আগেভাগে ভোগ্যপণ্য মজুদ শুরু করার ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে রমজানের অত্যাবশ্যকীয় চারটি ভোগ্যপণ্যের দাম। ঢাকার বাজারে শুক্রবার পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু ও ডালের দাম বেড়েছে। এছাড়া ৩ দিনের ব্যবধানে দু’দফায় চিনির দাম বেড়েছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধির চিত্র বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার দর মূল্য তালিকায়ও দেখা গেছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নয়াবাজার ও শান্তিনগর কাঁচাবাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশি পেঁয়াজ ২৭-৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। যা একদিন আগেও ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কারওয়ান বাজারের খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দু’দিন আগেও ২৫ টাকা কেজিতে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। কিন্তু শুক্রবার বিক্রি করছি ২৭-২৮ টাকা কেজি দরে। এছাড়া একটু ভালোমানের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করছি ৩০ টাকা কেজি দরে। দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, রমজান এলেই পেঁয়াজের দাম বাড়ে। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। পাইকারি পর্যায়ে ২-৩ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। তাই বেশি দাম দিয়ে এনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। রাজধানীর বাজারগুলোতে ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি কেজি আলু শুক্রবার ১৮-২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। যা গত সপ্তাহে ১৫-২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বর্তমানে দেশে চিনির তিনগুণ মজুদ থাকার পরও ৩ দিনে দু’দফায় দাম বেড়েছে। বুধবার পাইকারি পর্যায়ে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) খোলা চিনিতে ৭০-৮০ টাকা বেড়ে ২৪৮০-২৪৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর খুচরা পর্যায়ে প্রতি বস্তা চিনি বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা বেশিতে। দু’দিনের ব্যবধানে শুক্রবার আরেক দফা বেড়েছে চিনির দাম। পাইকারি পর্যায়ে প্রতি বস্তায় ২০-৩০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ২৫১০ টাকায়। আর খুচরাতে বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা ২৬৫০ টাকায়। চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারেও চিনির দাম বৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে। অপরদিকে, টিসিবির তালিকা অনুযায়ী মানভেদে আদা ৯০-১৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। যা গত সপ্তাহে ৯০-১২০ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া রসুন মানভেদে ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা গত সপ্তাহে ৯০-১১০ টাকায় বিক্রি হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, ‘রমজানের আগে বা পরে নিত্যপণ্যের দাম যাতে সহনীয় থাকে সেজন্য বাজারে অধিদফতরের একাধিক টিম কাজ করছে। মোকাম, পাইকারি পর্যায় ও খুচরা পর্যায়ে শনিবার ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা হবে। দাম বাড়ানোর পেছনে কোনো ধরনের অনৈতিক কারণ থাকলে দোষীদের চিহ্নিত করে ভোক্তা আইনে শাস্তির আওতায় আনা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘এবার রমজানে পণ্যের দাম বাড়াতে দেয়া যাবে না। অসাধুরাও যাতে দাম বাড়াতে না পারে সে দিকে নজর রাখা হবে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, রমজানকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ইতিমধ্যে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ক্যাবের পক্ষ থেকে আমরা বারবার বলেছি, বাজারে যেন লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করা না হয়। অনেক সময় দেখা গেছে- অভিযানের সময় বাজারে পণ্যের দাম ঠিকঠাক থাকে। কিন্তু অভিযান শেষ হওয়ার পরপরই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। এজন্য আমরা বলেছি সার্বক্ষণিক বাজার মনিটরিং করতে হবে। যতক্ষণ বাজার চলবে ততক্ষণ বাজার মনিটরিং করতে হবে। গুদাম, পাইকারি ও খুচরা বাজারসহ সর্বস্তরে নজরদারি বাড়ানো উচিত। বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, রমজানের আগে বা রমজানের সময় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো কাম্য নয়। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফা করতে পণ্যের দাম বাড়ায়। দেশে যে পরিমানে পণ্য আছে তাতে পণ্যের দাম বাড়ানোর কথা নয়। আবার কিছু কিছু পণ্যের দাম রমজানের এক মাস আগ থেকেই বাড়ানো হয়। এ কারণে সরকারের মনিটরিং সংস্থাগুলোর উচিত কঠোরভাবে মনিটরিং করে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা।





আরো খবর