মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল, ১৪৪৫ | ০৮:১৫ অপরাহ্ন (GMT)
ব্রেকিং নিউজ :
X
শিরোনাম :
  • নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে আ.লীগ: কাদের
  • ইসি নয়, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে হার্ডলাইনে যাবে বিএনপি


সোমবার, ২৫ মার্চ ২০১৯ ০৩:১১:৪৪ পূর্বাহ্ন Zoom In Zoom Out No icon

মহাসমারোহে সারা দেশে চলছে সড়ক-সন্ত্রাস

একই পথে নিয়মিত অফিসে গমনাগমন করি। পথ একেকদিন একেক রূপ নিয়ে সামনে আবির্ভূত হয়। দেখা গেল, আগেরদিন পথের যেখানে কাউকে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, পরদিন সেখানে অন্য একজন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। আগেরদিন যে নারীর মায়াভরা চোখমুখ দেখে অভিভূত হয়েছি, পরেরদিন সেখানে কঠিন চেহারার এক নারী দাঁড়িয়ে আছেন। সময়ের স্রোতে ভেসে চলা পথচারীদের রূপ ও অবস্থান প্রতিমুহূর্তে পাল্টাচ্ছে; আমি সামান্য একটি অংশের সাক্ষী মাত্র। এই মুহূর্তে সাক্ষী হয়েছি যে দৃশ্যের, তার সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিটি রাষ্ট্রের সম্পদ। রাষ্ট্রীয় পোশাক-অস্ত্র ও অন্যান্য সাজ-সরঞ্জামের অধিকারী হয়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট কালো রোদচশমায় দু’চোখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছেন। আশেপাশে একাধিক কনস্টেবল ব্যস্ত সময় পার করছে। যে বাসটির যাত্রী আমি, হঠাৎ একজন কনস্টেবলের হাতের ইশারায় চলৎশক্তি হারিয়ে রাস্তার একপাশে থেমে গেল। ভেবেছিলাম, অনেক ঝামেলা হবে। সেসব কিছ্ইু ঘটল না। দেখলাম, বাসের হেলপার একশ’ টাকার একটা নোট কনস্টেবলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশে চিৎকার দিল- : ওস্তাদ, গিয়ার লাগান... বাসের দরজার ঠিক পাশের সিটে বসেছি। হেলপার ফিরে এসে বাসের হ্যান্ডেলে বানরের মতো ঝুলে পড়তেই জিজ্ঞেস করলাম- : কী মিয়া! গাড়ির কাগজপাতি ঠিক আছে? : একশ’ দশ পার্সেন্ট ঠিক। : তাইলে ট্রাফিকরে টাকা দিলা কেন? কথা শুনে বাসের হেলপার মুচকি হাসল। বলল- : এইটা হইল সকালের নাস্তা। হেরে নাস্তা না খাওয়াইলে উল্টা আমারে মামলা খাওয়াইয়া দিবে। অবাক হয়ে বললাম- : গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকলে মামলা দিবে কিভাবে? হেলপার ফিক ফিক করে হাসল কিছুক্ষণ। তারপর বলল- : কাগজপত্র ঠিক থাকলেই কী! আসমানে যত তারা; পুলিশের তত ধারা। পুলিশের খাতায় ধারার অভাব নাই। একটা না একটা কারণ দেখাইয়া মামলায় ঢুকাইয়া দিবে। : কত টাকার মামলা দেয়? : ঠিক নাই। পাঁচশ’, নয়শ’; আবার ১৫শ’ টাকার মামলাও দেয়। সবকিছু নির্ভর করে স্যারের মেজাজ-মর্জির ওপর। ছোট-বড় সব ঘটনাপ্রবাহ মহাকালের গর্ভে সঁপে দিয়ে বাস সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কখনও থামছে; কখনও দৌড়াচ্ছে। রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় একসময় ‘গেটলক’, ‘সময় নিয়ন্ত্রণ’ ইত্যাদি সার্ভিস চালু হয়েছিল। এসব সার্ভিসের মান ও ধরন নিয়ে তখন বাসযাত্রীদের সঙ্গে কন্ডাকটর-হেলপারের কথা কাটাকাটি-ধরাধরি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মানুষ এসবে বিশ্বাস হারানোর পর শুরু হল ‘ডাইরেক্ট’ সার্ভিসের যুগ। ডাইরেক্ট সার্ভিস যখন ল্যাংড়া হয়ে গেল, সেসময় একদিন দেখলাম- যাত্রীদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য একটা বাসের শরীরে লিখে রাখা হয়েছে- ‘আল্লাহর কসম ডাইরেক্ট সার্ভিস’। বর্তমানে রাজধানীতে ডাইরেক্ট বলে কোনো বাস সার্ভিস নেই; সবই লোকাল। লোকাল শব্দটার মধ্যে ল্যাবড়া-চ্যাবড়া জাতীয় একটা বিষয় আছে। স্মার্ট বাসমালিকরা এটা দূর করতে নতুন একটা ফন্দি বের করেছে। রাজধানীতে চলাচলকারী অধিকাংশ বাসের গায়ে এখন ‘কম স্টপেজ সার্ভিস’ লেখা স্টিকার শোভা পাচ্ছে। কম মানে কত কম- এর কোনো সীমারেখা না থাকায় একমাত্র ফ্লাইওভার ছাড়া বাদবাকি রাস্তায় বাসগুলো হাঁটতে হাঁটতে দৌড়াদৌড়ি করছে। মিরপুর এক নম্বরে এসে বাসটা আবারও ঝামেলায় পড়ল। ড্রাইভার নিজেই কাগজপত্র নিয়ে সার্জেন্ট বাহদুরের কাছে ছুটে গেল। মনে হচ্ছে, ছোটখাটো ঝামেলা নয়; অনেক বড় ঝামেলা। ঝামেলা পরিমাপ করতে গিয়ে মনে হল, বিয়েবাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। গেটের ওপাশে কনেপক্ষের ধুড়া-আধুড়া পোলাপান বরপক্ষের লোকজনের সঙ্গে পয়সাকড়ি নিয়ে দর কষাকষি করছে। হঠাৎ একজন যাত্রী চিৎকার করে উঠতেই মনের ক্যাভাসে তৈরি হওয়া দৃশ্যকল্প বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেল। বাসের জানালা দিয়ে আসা বাইরের রোদ চোখের পাতা স্পর্শ করতেই পূর্ণদৃষ্টিতে সামনে তাকালাম। চিৎকার-মানব রাগে গজগজ করতে করতে ট্রাফিক সার্জেন্টের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন- : মানুষ চোর ধরে; ডাকাত ধরে। এরা হইল বড় ডাকাত। মানুষ এই ডাকাতদের ধইরা হাড্ডিগুড্ডি গুড়া কইরা দেয় কেন? আহা রে! ভদ্রলোকের নিশ্চয়ই গন্তব্যে পৌঁছার তাড়া আছে; তাই এমন করছেন। তাকে যাতনার ভাগীদার হওয়ার জন্য ঠোঁট ফাঁক করেছি- এসময় পাশ থেকে একজন যাত্রী বলে উঠলেন- : ধরবেন কেমনে? এরা হইল লাইসেন্স পাওয়া ডাকাত। বাস, ট্রেন কিংবা চায়ের দোকানে কোনো প্রসঙ্গে কথা উঠলে বক্তার অভাব হয় না। এখানেও তাই ঘটল। অল্পবয়েসী এক যাত্রী রাগে ফুলতে থাকা যাত্রী ভদ্রলোকের উদ্দেশে বলল- : মুরুব্বি যান; ব্যাটারে ধইরা লইয়া আসেন। ভদ্রলোক ‘হাফ গরম’ ছিলেন। এবার ‘পুরো গরম’ হয়ে গেলেন। বললেন- : আমি একলা যাব কেন? বাসে তো আপনেরাও আছেন। চলেন, সবাই মিইল্যা যাই। সবাই মিলে গেলেই কাজ হবে কী? রাষ্ট্রের দেয়া পোশাকে সুরক্ষিত সার্জেন্ট বাহাদুর ইচ্ছে করলে রাস্তায় চলাচলকারী যে কোনো যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন। আইনের অন্তরালে তিনি ‘অকাম’ কী করছেন, সেটা কেউ বিবেচনায় নেবে না; বরং অন্যায়ের প্রতিকার করতে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি যদি তার সঙ্গে তর্কে জড়ায়, ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এদেশে আইনের বর্ম পরিধানকারীরা যখন-তখন যানবাহন থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। এখানে সেরকম কিছু ঘটছে না- এটাই শুকরিয়া। সার্জেন্ট বাহাদুরের দোয়া নিয়ে বাস হামাগুড়ি দিতে দিতে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মিরপুর ১২ নম্বর পার হওয়ার পর একটু ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায়। মনে হচ্ছে, এখানকার বাতাস কিছুটা কম বিষাক্ত। আহ! চোখ বন্ধ করে ফুসফুসে বাতাস ভরছি- এমন সময় শোরগোল ভেসে এলো। চোখ মেলে দেখি- বাস মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে ‘ফুল গরম’ ভদ্রলোক এবার নতুন একটা বিষয়ে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে উচ্চস্বরে বললেন- : বলেন দেখি, এর চাইতে বড় তামাশা জগতে আর কিছু কি আছে? ভদ্রলোক কী বিষয়ে কথা বলছেন, বুঝতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করতেই একটা সাইনবোর্ডের দিকে আপমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন- : চুদির ভাইয়েরা এই যে লেইখা রাখছে- বাস দাঁড়াইলেই দণ্ড; কই! কোনো তাউয়ের পুতের তো জেল-জরিমানা কিছুই হইতেছে না! বুঝলেন, এইটা হইল এক ধরনের ভণ্ডামি। আফসোস! সারা দেশেই এই কিসিমের ভণ্ডামি বেশুমার চলতেছে। বিষয়টা এবার পরিষ্কার হল। দেখলাম, রাস্তার মোড়ে একটা সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে; সেখানে লেখা- এখানে বাস দাঁড়ানো নিষেধ। দাঁড়ালেই দণ্ড। দণ্ডদাতা কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের নাম লেখা রয়েছে। রাস্তায় চলাচলকারী প্রতিটি বাস মোড়ে এসে থামছে; যাত্রীরা উঠানামা করছে। আশেপাশে দণ্ডদাতা কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত আছেন কিনা, তালাস করলাম। না, কেউ নেই। সাগরের কচ্ছপ ডাঙ্গায় ডিম পেড়ে পুনরায় সাগরে চলে যায়। সেসব ডিম নষ্ট হল, নাকি গুঁইসাপের পেটে গেল- এ নিয়ে কচ্ছপগোষ্ঠির কোনো মাথাব্যথা থাকে না। এক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। ভদ্রলোক বাসের হেলপারকে বললেন- : এই ব্যাটা, যা তো; সাইনবোর্ডটা উল্টাইয়া রাইখ্যা আয়। প্রতিদিন আসা-যাওয়ার পথে এ সাইনবোর্ড চোখে পড়ে; আমার মধ্যে কোনোরকম প্রতিক্রিয়া হয়নি। ভদ্রলোকের কথা শোনার পর মনে হল- সাইবোর্ডটা আসলেই উল্টে রাখা উচিত। এ সাইবোর্ডের মাধ্যমে মানুষকে প্রতিনিয়ত আইন অমান্য করতে প্ররোচিত করা হচ্ছে। মানুষ যখন দেখবে, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ঘোষণার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই; তখন তারা নিঃসন্দেহে আইনকে অবজ্ঞা করতে শিখবে। ছোট ছোট আইনগুলো অবজ্ঞা করতে করতে তারা এক সময় বড় ধরনের আইনগুলো অবজ্ঞা করার সাহস দেখাবে। এই যে ড্রাইভার-হেলপার থেকে শুরু করে পরিবহন সেক্টরের সবাই সারা দেশে মহাসমারোহে সড়ক-সন্ত্রাস চালাচ্ছে, এ তারই ফল। আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীর শাস্তির বিধান আইনে রয়েছে। সড়কে আইন অবজ্ঞা করতে প্ররোচনা যোগাচ্ছে যারা, তাদেরও কি শাস্তি হওয়া উচিত নয়? গুলশান দুই নম্বর গোলচক্কর পৌঁছার পর বাস থেকে নেমে পড়লাম। মূল সড়ক পার হয়ে গলিতে পৌঁছার পর একজন রিকশাওয়ালার মনোযোগ আকর্ষণ করে ব্যর্থ হওয়ার পর বললাম- : ওই মিয়া, এত ফ্যাটাঙ্গ কিসের তোমার? ডাকতেছি, শোন না? রিকশাওয়ালা ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে। তার ভাব লক্ষ করে বললাম- : কী হইল, যাবা না? : না। : কেন! : গদি নাই। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই রিকশার সিট নেই। আশ্চর্য হয়ে বললাম- : গদি গেছে কই! : লইয়া গেছে। : কে লইয়া গেছে? রিকশাওয়ালা হাত তুলে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক পুলিশের একজন কনস্টেবলকে দেখিয়ে দিল। মূল সড়কে রিকশার প্রবেশ নিষিদ্ধ; ট্রাফিক পুলিশ তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন ভেবে আমি অন্য রিকশার খোঁজে সামনে পা বাড়াতেই রিকশাওয়ালা অনুনয় করে বলল- : স্যার, আমি গরীব মানুষ। আপনে একটু বইলা দেন- গদিটা যাতে দিয়া দেয়। বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম- : তুমি গলি ছাইড়া মেইন সড়কে ঢুকছো কেন? : পুলিশই টাকা খাইয়া আমারে ঢুকতে দিছিল। : ঢুকতে দিলে এখন গদি নিয়া গেছে কীজন্য? রিকশাওয়ালা এ প্রশ্নের উত্তর দিল না। অন্য একটা রিকশায় আরোহণের পূর্বে গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা আইনের এ রক্ষকের উদ্দেশে বললাম- : ভাই, রিকশাওয়ালা গরীব মানুষ; ওর গদিটা দিয়া দেন। পানখাওয়া মুখের কয়েক পাটি দাঁত বের করে কনস্টেবল বললেন- : গদি তো আমার কাছে না। : কার কাছে? : গদি বক্সে চইলা গেছে। বক্স বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। আমি যে রিকশায় সওয়ার হয়েছি, তার চালক বিষয়টা পরিষ্কার করে বলল- : গদি একবার পুলিশ বক্সে চইলা গেলে ৫০ থেইকা ৮০ টাকার মামলা। কান্নাকাটি কইরা লাভ নাই; এই টাকা ওর লাগবই...





আরো খবর