শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ রমজান, ১৪৪৫ | ০১:১৪ অপরাহ্ন (GMT)
ব্রেকিং নিউজ :
X
শিরোনাম :
  • নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে আ.লীগ: কাদের
  • ইসি নয়, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে হার্ডলাইনে যাবে বিএনপি


মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০১৯ ০৩:৪৯:৪৪ পূর্বাহ্ন Zoom In Zoom Out No icon

চক্রবৃদ্ধি নয়, ঋণের হিসাব হবে সরল হারে : অর্থমন্ত্রী

খেলাপি ঋণের সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে হিসাবের কারণে গ্রাহকের নানা সমস্যা হচ্ছে। পৃথিবীর কোনো দেশে এটি নেই। তাই আগামী বাজেটের আগেই এটি তুলে দেওয়া হবে। খেলাপি ঋণের সুদ সরল হারে গণনা করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গতকাল সোমবার শেরেবাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি, চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি এ কথা জানান। তিনি খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘খারাপ বা অসাধু ব্যবসায়ী যাঁরা আছেন, যাঁরা টাকা নিয়ে দেননি তাঁদের কাছ থেকে যেভাবেই হোক টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করব। ’ আর্থিক বা ব্যাংকিং খাতের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করতে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার কথাও তিনি বলেন। অর্থমন্ত্রী এ-ও বলেন, একটা কম্পানিতে একাধিক মালিক থাকলে এর মধ্যে একজনের ঋণ খেলাপি হলে পুরো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। আবার গ্রুপ কম্পানির মধ্যে একটা খারাপ হলে তার জন্য সব বন্ধ করতে হবে—এটা সঠিক নয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রীর বেসামরিক শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। অর্থমন্ত্রী ভালো ব্যবসায়ীদের সাহায্য করার পাশাপাশি যোগ্য ব্যক্তিদের ব্যাংকে বসানো হবে বলেও মন্তব্য করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আর্থিক বা ব্যাংকিং খাতে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। এটা দীর্ঘদিন থেকেই আছে। এ ত্রুটি-বিচ্যুতি বাড়তে বাড়তে এখন এমন একটা পর্যায়ে এসেছে যে এটাতে এখন হাত দিতে হবে। আমরা এ জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করব। ’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কী পরিমাণ সম্পদ আছে তা জানতে হবে। সে জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে স্পেশাল অডিটের ব্যবস্থা করেছি। আর কারা ভালো ব্যবসায়ী, খারাপ ব্যবসায়ী, তাদের সম্পর্কে জানতে হবে। ভালো ব্যবসায়ীদের আমরা সাহায্য করব। ’ ঋণখেলাপিদের ঋণ সরল সুদে গণনা করা হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের হিসাবের কারণে গ্রাহকের নানা সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংক ঋণে দেখা যায়, তিন মাস, চার মাস বা ছয় মাসে সুদের হিসাব হচ্ছে। সুদের ওপর আবার সুদ বসানো হয়। এটা তুলে দেওয়া হবে। ঋণের হিসাব চক্রবৃদ্ধিতে নয়, সরল হারে হিসাব হবে। আগামী বাজেটের আগেই এটি তুলে দেওয়া হবে। চলতি অর্থবছর ৮.২৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করছেন জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘চলতি অর্থবছর আমরা ৮.১৫ থেকে ৮.২৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রত্যাশা করছি। গত অর্থবছর আমাদের ৭.৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর আগের অর্থবছর ৭.২৮ শতাংশ হয়েছে। তার আগের অর্থবছর ৭.১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এত বছর লাগাতার ৭ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি পৃথিবীর কোনো দেশে দেখিনি। এ অসাধারণ অর্জন কেমন করে হয়েছে? ব্যাংক যদি একদম খারাপ হয়, তাহলে কিভাবে এত অর্জন করলাম? ব্যাংক সম্পর্কে আমরা যা শুনছি তা আসলে ঠিক নয়। তবে কিছু ভুল ক্যালকুলেশন, ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। ’ মন্ত্রী বলেন, ‘যোগ্য ব্যক্তিদের ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ করা হবে। যাঁরা যোগ্য তাঁদের হাতে ব্যাংক তুলে দেওয়া হবে। ইন্টারভিউ নিয়ে তারপর ব্যাংক পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হবে। ব্যাংক পরিচালক নিয়োগ নিয়ে আমার কাছে কোনো সুপারিশ এলে তা গ্রহণ করা হবে না। ’ এ সময় তিনি ব্যাংকারদের উদ্দেশ করে জানতে চান, ‘এতে কি আপনারা রাগ করেছেন? রাগ করলে কিছু করার নেই। ব্যাংকে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দেওয়া হবে। ’ এ সময় তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের ক্ষেত্রে এখন যে বিশ্বাসের জায়গাটুকুতে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা আমরা ঠিক করব। আর যে পরিমাণ ব্যাংক আছে তা ১৬ কোটি মানুষের জন্য বেশি নয়। নাম্বার কোনো বিষয় নয়। ’ সবাইকে নিয়ে উইন উইন সিচুয়েশনের পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো, ভালোদের সাহায্য করা আর খারাপদের শাস্তি দেওয়া। তবে আমরা কাউকে জেলে পাঠিয়ে শাস্তি দিতে চাই না। সবাইকে নিয়ে উইন উইন সিচুয়েশন তৈরি করা হবে। তবে যেসব কর্মকর্তা খারাপদের সাহায্য করেছেন তাঁরাও দায়ী। এ জন্য তাঁদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। ’ ব্যাংকিং সেক্টরের অভিভাবক কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগও মাঝেমধ্যে অভিভাবকের মতো আচরণ করে। এতে ব্যাংকিং সেক্টরে দ্বৈত অভিভাবক হয়ে গেল কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এখানে একজন অভিভাবকই আছেন। তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়বে সেগুলোকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ ক্ষেত্রে যে বা যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কাগজপত্র যাচাই করার প্রতি জোর দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। বৈঠকে ভালো ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি তিনি খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকগুলোকে কিভাবে ভালো করা যায় সে জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবে। কর্মপরিকল্পনার আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি যেসব আইনে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে সেগুলোকে সংশোধন করে আরো শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বৈঠকে। এ কাজগুলোও করবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠকের সূত্রটি জানায়, বৈঠকে খেলাপি ঋণে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ গণনার ওপর দীর্ঘ আলোচনা হয়। এ সময় বিশ্বের অন্যান্য দেশে ঋণের সুদ কিভাবে গণনা করা হয় তা বাংলাদেশ ব্যাংক বিস্তারিত তুলে ধরে। এতে বলা হয়, সরল সুদে ঋণ গণনা করলে খেলাপি ঋণ অনেক কমে আসবে। বর্তমানে যারা ঋণখেলাপি রয়েছে তারাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহী হবে। বিষয়টির সঙ্গে উপস্থিত সবাই একমত পোষণ করে। তবে অর্থমন্ত্রীর এ উদ্যোগকে ভালোভাবে দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা ভালো ঋণ গ্রহীতার কাছে খারাপ বার্তা যাবে। তাই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার আগে ভাবা উচিত। ’ বৈঠকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে, ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা তথা ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ জানতে শিগগিরই স্পেশাল অডিট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি বাজেটের আগেই পরিচালনা করা হতে পারে। এ ছাড়া পরিদর্শকদলের সংখ্যাও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঋণের সুদ সরল হারে গণনা করার বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক ডিজি তৌফিক আহমেদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এর ফলে ঋণখেলাপিদের সরাসরি সুবিধা দেওয়া হলো। ঋণখেলাপিরা এখন ঋণ পরিশোধে অনীহা দেখাবে। এদের বারবার সুবিধা দেওয়ার ফলে তারা আর ভয় পাবে না। ঋণ পরিশোধ করবে না। বরং ভালো গ্রহীতারা ভাববে, ঋণখেলাপি হওয়াই ভালো। সুবিধা পাওয়া যায়। আর এটা ডিপোজিটরদের সঙ্গে অন্যায় হলো। কারণ ডিপোজিটরদের চক্রবৃদ্ধি হারেই সুদ দিতে হবে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার কোনো জায়গা থাকল না। পাশাপাশি এতে ব্যাংকের আয়ও কমে যাবে।





আরো খবর