বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল, ১৪৪৫ | ০১:১৫ পূর্বাহ্ন (GMT)
ব্রেকিং নিউজ :
X
শিরোনাম :
  • নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে আ.লীগ: কাদের
  • ইসি নয়, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে হার্ডলাইনে যাবে বিএনপি


সোমবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ ০২:০৬:১৭ পূর্বাহ্ন Zoom In Zoom Out No icon

ক্রিসেন্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে দুদকের পাঁচ মামলা

ঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় জনতা ব্যাংকের ডিএমডিসহ ১৫ কর্মকর্তা এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান ও পাঁচ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সাতজনসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়েছে। রোববার রাজধানীর চকবাজার মডেল থানায় দুদকের সহকারী পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান মামলাগুলো করেন। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন অনুসন্ধান কাজ তদারক করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, রফতানি বিল ক্রয় প্রক্রিয়ায় (ফরেন ডকুমেন্ট বিল পার্সেস বা এফডিবিপি) জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ক্রিসেন্টের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্ট ৫০০ কোটি ৭০ লাখ, ক্রিসেন্ট ট্যানারি ৬৮ কোটি, লেসকো ৭৫ কোটি, রূপালী কম্পোজিট ৪৫৪ কোটি এবং রিমেক্স ফুটওয়্যার ৬৪৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ, ক্রিসেন্ট লেদার ও রূপালী কম্পোজিট, লেদারওয়্যারের চেয়ারম্যান এমএ কাদের, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তার স্ত্রী সুলতানা বেগম, রূপালী কম্পোজিটের পরিচালক ও এমএ কাদেরের মেয়ে সামিয়া কাদের নদী, রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান ও এমএ কাদেরের ভাই আবদুল আজিজ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আবদুল আজিজের স্ত্রী লিটুল জাহান মির, ক্রিসেন্ট লেদারের পরিচালক রেজিয়া বেগম এবং মেসার্স লেক্সকো লিমিটেডের পরিচালক মো. হারুন-অর-রশীদ। জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা হলেন- তৎকালীন ব্যাংকের ফরেন ট্রেড ডিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার এবং বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) মো. ফখরুল আলম, তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ঢাকা দক্ষিণ ও বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি মো. জাকির হোসেন, তৎকালীন ব্যাংকের ফরেন ট্রেড ডিভিশনের ডিজিএম এবং বর্তমানে প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম কাজী রইস উদ্দিন আহমেদ। এছাড়া রয়েছেন- নোট প্রস্তুতকারী সিনিয়র অফিসার মো. আবদুল্লাহ আলম মামুন, পরীক্ষণকারী সিনিয়র অফিসার মো. সাইদুজ্জামান, সুপারিশকারী প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মো. রুহুল আমিন, সিনিয়র প্রিন্সিপ্যাল অফিসার মো. মগরেব আলী, মো. খায়রুল আমিন, এজিএম আতাউর রহমান, অনুমোদনকারী ডিজিএম মো. রেজাউল করিম, মোহাম্মদ ইকবাল, একেএম আসাদুজ্জামান, জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার বাহারুল আলম এবং প্রধান কার্যালয়ের এসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার এসএম শরীফুল ইসলাম। অনুসন্ধানে ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ কাদের ও তার স্ত্রীসহ মালিকপক্ষের সাতজন এবং ব্যাংকের জিএম থেকে নোট প্রস্তুতকারী কর্মকর্তা পর্যন্ত ১৫ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এ ২২ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করার প্রমাণ মিলেছে। ইতিমধ্যে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মামলার তথ্য অনুযায়ী, ক্রিসেন্ট গ্রুপের রফতানি বিল কিনে নিয়েছে জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা। নিয়ম অনুসারে আগাম টাকার প্রয়োজনে কোনো রফতানিকারক পণ্য রফতানির পর এ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র জমা দিয়ে ব্যাংকের কাছে টাকা চাইতে পারে। এক্ষেত্রে ওই ব্যাংক বিল কিনে নিয়ে রফতানিকারককে ৯০ শতাংশ টাকা পরিশোধ করার বিধান রয়েছে। ব্যাংকিংয়ের ভাষায় এ প্রক্রিয়াকে ‘ফরেন ডকুমেন্ট বিল পার্সেস (এফডিবিপি)’ বলে। তবে এফডিবিপির ক্ষেত্রে অবশ্যই ১২০ দিনের মধ্যে ব্যাংকে টাকার পরিশোধে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মাধ্যমে ব্যাংককে শতভাগ নিশ্চিত হতে হয়- বিলের টাকা পাওয়া যাবে। আর এ প্রক্রিয়ার (এফডিবিপি) মাধ্যমেই ক্রিসেন্ট গ্রুপ টাকা নিয়েছে। এক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড শিপিং লাইন এবং ইউরো এশিয়া শিপিং লাইনের নামে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ব্যাংকে দাখিল করা হয়েছে। হংকং, থাইল্যান্ড ও দুবাইতে নিবন্ধিত সান পল লেদার ক্র্যাফট, বায়ো লি ডা ট্রেডিং কর্পোরেশন, মার্চেন্ট ট্রেড গ্যারান্টি কর্পোরেশন কোম্পানি, ব্রাইট বিউ জেনারেল ট্রেডিং নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিল দাখিল করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ডকুমেন্ট নেয়া হয়েছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার এক্সিও ক্রেডিট ব্যাংক লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান থেকে। এ ব্যাংক থেকে ২২১টি এলসি ইস্যু করা হয়েছে। তবে আদৌ এ সংক্রান্ত কোনো এলসি খোলা হয়েছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। সূত্র জানায়, এ ঋণের ক্ষেত্রে ক্রিসেন্ট গ্রুপ বেশ কয়েকটি আইনের তোয়াক্কা করেনি। রফতানি বিল ক্রয়ের ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানে সন্তোষজনক ক্রেডিট রিপোর্ট জরুরি। আর প্রথম লেনদেনের আগে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু এ নির্দেশনাও মানেনি জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা। ফলে নিয়মবহির্ভূতভাবে ক্রিসেন্টকে একটি বিলের বিপরীতে ৩৪৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, অসৎ উদ্দেশ্যে বিশ্বাসভঙ্গ করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ে রফতানি না করেও ভুয়া এফডিবিপি ডকুমেন্ট ও প্যাকিং ক্রেডিট দিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এ প্রক্রিয়ায় গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। ফলে এটি আত্মসাৎ বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত। এ কারণে আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করা হয়। মামলায় বলা হয়, ক্রিসেন্ট গ্রুপের টাকা পাচারের ক্ষেত্রে ব্যাংকের যেসব দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- দেশের বাইরের ব্যাংকের সঙ্গে এলসি খোলার সময় ওই ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কিনা তা যাচাই করেনি জনতা ব্যাংক। আর রফতানি চুক্তিতে কোনো সাক্ষীর স্বাক্ষর নেই। যা আন্তর্জাতিক আইনে গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া এফডিবিপি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের স্বাক্ষর যাচাই করা হয়নি। জনতা ব্যাংকের নীতিমালায় ত্রুটিপূর্ণ বিল ক্রয় না করার নিয়ম থাকলেও সেটি মানা হয়নি। বিল ক্রয়ের ক্ষেত্রে আমদানিরকারকের এক্সেপটেন্স (সম্মতি) বাধাত্যমূলক থাকলেও সেটি লঙ্ঘন করা হয়েছে। ব্যাংকের ডকুমেন্টের সঙ্গে রিলেশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্লিকেশন না থাকায় সুইফট মেসেজ বিনিময়ের শর্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে। এর আগে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচারের অভিযোগে ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। ওই মামলায় সম্প্রতি কোম্পানির চেয়ারম্যান এমএ কাদের গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ঘটনায় বিচারের মাধ্যমে আর্থিক সুশাসনের নজির স্থাপন করা উচিত। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফ আইইউ বা আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান যুগান্তরকে বলেন, এটি আইনি ব্যাপার। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে তদন্ত করতে পারলেও মামলা করার আইনি ক্ষমতা নেই। দুদকসহ অন্য প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আইন অনুসারে মামলা করবে এটাই স্বাভাবিক।





আরো খবর