আন্তর্জাতিক / খাশোগি ইস্যুতে সৌদি, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র এখন কী করবে?
রোববার, ১৮ নভেম্বর ২০১৮ ০১:০০:৫১ অপরাহ্ন
খাশোগি ইস্যুতে সৌদি, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র এখন কী করবে?
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে শেষ পর্যন্ত তুরস্কের কথাই সত্য প্রমাণিত হলো। অনেক টালবাহানার পরে সৌদি আরবও স্বীকার করলো যে তাকে সৌদি কনসুলেটের ভিতরে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যা পর লাশ টুকরো টুকরো করা হয়েছে। এই বিষয়ে সর্বশেষ বোমা ফাটিয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।
ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয় সিআইএ তদন্তে এটা বেড়িয়ে এসেছে যে খাশোগি হত্যার পিছনে মূল ভূমিকায় ছিলেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
এখন প্রশ্ন হলো যদি সিআইএ তদন্তের ওই খবর সঠিক হয় যে খাশোগি হত্যার মূল হোতা বিন সালমান তাহলে সৌদি রাজ পরিবার তাকে রক্ষার জন্য কী করবে? আর এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্কের ভূমিকাই বা কী হবে?
প্রথমে সৌদি থেকেই শুরু করা যাক। সৌদি রাজ পরিবার যুবরাজকে রক্ষার সব পন্থায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশটি তিন দিক দিয়ে আগাচ্ছে।
১. আইনের সঠিক প্রয়োগের ধুলো দিয়ে ৫ জনের ফাঁসি আর ১৩ জনের কারাদণ্ড দেখিয়ে সারা বিশ্বকে বুঝতে চাচ্ছে যে যারা এই খুনের সাথে জড়িত তাদের বিচার করা হচ্ছে আর যুবরাজ বিন সালমান সম্পূর্ণ নির্দোষ।
২. এই বিচারের মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতকে শক্তিশালী করছে যাতে তিনি দেশে এবং বিদেশে জোর গলায় সৌদি সরকারের সাফাই গাইতে পারেন। তিনি ইতিমধ্যে দোষীদের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছেন!
৩. তুরস্কের সাথে গোপন আঁতাত করে যেন আঙ্কারার তদন্তে সরাসরি যুবরাজকে দোষী সাব্যস্ত করা না হয় তার বন্দোবস্ত করা ।
যদি প্ৰশ্ন করেন এক্ষেত্রে সৌদি কতটুকু সফল? বলতে হবে প্রায় ১০০% সফল। কিন্তু এই "প্রায়" এর মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে।
তুরস্ক ঠিকই এখনো পর্যন্ত বিন সালমানকে সরাসরি দোষী বলে নাই। কিন্তু তার মানে এই না যে সামনের দিনগুলোতে তদন্তের আঙ্গুল তার দিকে উঠবে না। তুরস্ক ইতিমধ্যে খাশোগি হত্যার সময় ধারণ করা দুইটি অডিও রেকর্ড আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে হস্তান্তর করেছে। ওই অডিও রেকর্ডগুলোতে হত্যার আগে, হত্যার সময় এবং হত্যার পরের অনেক কথাবর্তা আছে যাতে বুঝা যায় ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। ঘটনার আগে এবং পরে হত্যাকারীরা ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেট থেকে রিয়াদের সৌদি রাজপরিবারের উর্ধতন কারো কাছ থেকে অনুমতি নেয় আবার মিশন সফল ভাবে সম্পন্ন করার পরে তার কাছে রিপোর্ট দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গলবার নাগাদ তদন্দের রিপোর্ট প্রকাশ করবে। রিপোর্টে যদি সত্যিই বিন সালমানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাহলে ট্রাম্পের সুরে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। যদিও আমার মনে হয় না যে ট্রাম্প সৌদি রাজপরিবার বিশেষ করে বিন সালমানের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করার মতো কোনো পদক্ষেপ নিবেন।
তবে এরকম একটা রিপোর্ট রাজপরিবারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ আরো বাড়াবে আর তুরস্কের হাতকে আরো শক্তিশালী করবে।
হয়তো সৌদি রাজপরিবার বিন সালমানকে কিছুদিন নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারে।
আর তুরস্কের সাথে এবিষয়ে সৌদি বা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো গোপন চুক্তি হয়েছে কিনা?
এর উত্তরে বলতে পারি এখনো আলোচনা চলছে কিন্তু চুক্তি হয়নি। তুরস্কের এক্ষেত্রে যে চাহিদা তা মেটাতে ওয়াশিংটন বা রিয়াদ কেউই সামনে আগাচ্ছে না। তারা সময় ক্ষেপন করে বিষয়টির আস্তে আস্তে
স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্তি ঘটানোর চেষ্টা করছে।
তুরস্ক এখনো জোর গলায় বলছে যে তারা এই দতন্তের শেষ উদ্ঘাটন করেই ছাড়বে। কিন্তু এক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক তদন্তের কোনো ডাক আঙ্কারা দেয়নি।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ এবং সরকারি কর্মকর্তারা শুরু থেকেই খাশোগি হত্যা নিয়ে যে বর্ণনা দিয়ে আসছে তা একে একে সত্য প্রমাণিত হলো।
সুতরাং দেখার বিষয় হলো সৌদি আরব এবং তুরস্ক একটা বিষয় একমত হয় কি না: এই হত্যাকাণ্ডে যুবরাজ বিন সালমান সরাসরি জড়িত।
সৌদি আরবের একের পর এক স্বীকৃতি:
১. প্রথম তারা বললো, খাশোগিকে হত্যা করা হয়নি তিনি কনস্যুলেট অফিস থেকে জীবন্ত এবং অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে গেছেন।
২. কয়েকদিন পরে বললো, না খাশোগি জীবন্ত বের হননি, তিনি ইস্তানবুল কনস্যুলেট এর মধ্যেই মারা গেছেন। কিন্তু তিনি মৃত্যুটা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে হাতাহাতিতে।
৩. পরে রিয়াদ থেকে বলা হলো, তিনি মারা গেছেন কিন্তু লাশ কোথায় আছে তা সৌদির কেউ জানে না।
৪. এর কিছুদিন পরে বললো, তার লাশ ইস্তানবুলের স্থানীয় এক সহযোগীর কাছে হস্তান্তর করা হয় কিন্তু সেই সহযোগী কে, তার নাম ঠিকানা কি? এসব সৌদি আরব জানে না।
৫. এরপরে সৌদি আরব বললো, তাকে পূর্বপরিকল্পিত ভাবেই হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু যারা হত্যা করছে তারা এটা তাদের নিজেদের ইচ্ছায় করেছে সৌদি রাজপরিবারের কেউ তাদেরকে এভাবে হত্তাকরার আদেশ দেয়নি।
৬. এর পরে বললো, হত্যার সাথে সৌদির গোয়েন্দা প্রধান, বিন সালমানের প্রধান উপদেষ্টা এবং সে দেশের আরো অনেক রাঘব বোয়াল যারা রাজপুতের ডান হাত তারা জড়িত কিন্তু রাজপুত্র কিছুই জানেন না।
৭. সর্বশেষ বিবৃতিতে সৌদি আরব স্বীকার করলো যে ওই সাংবাদিককে হত্যার পরে কনস্যুলেট ভবনের মধ্যেই তার লাশকে টুকরো টুকরো করা হয়।
সৌদি আরবের এখন আর দুটি বিষয় স্বীকার করা বাকি আছে:
১. লাশের ওই টুকরোগুলোকে রাসয়নিক পদার্থ দিয়ে নিঃশেষ করা হয়েছে।
২. আর রাজপুত্র বিন সালমান এই ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত।
সবকিছু স্বীকার করেও হয়তো সৌদি আরব পশ্চিমা চাপ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বদৌলতে রক্ষা পাবে। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো তুরস্ক এই বিষয়ে সৌদি এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে কতটুকু ফায়দা লুফে নিতে পারবে?
তুরস্ক যে সব দাবি উত্তোলন করছে বলে আমার মনে হয় সেগুলো হলো:
১. সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কুর্দি সশস্ত্র বাহিনী YPG/PYD থেকে আমেরিকা এবং সৌদি সমর্থন তুলে নেয়া।
YPG / PYD গ্রূপকে তুরস্ক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে গণ্য করে এবং নিজের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে মনে করে। YPG/PYD হচ্ছে PKK সন্ত্রাসী গ্রুপের সিরিয়ার শাখা। PKK সন্ত্রাসী গ্রুপ তুরস্কের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে প্রায় তিন দশক ধরে সশস্ত্র সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে এপর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি হয়েছে। আমেরিকা PKK কে সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসেবে দেখে। YPG/PYD কে PKK এর শাখাও মনে করে। কিন্তু YPG/PYD কে সিরিয়ায় শত শত ট্রাক অস্ত্র দিচ্ছে আর সৌদি আরব তাদেরকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করছে।
তুরস্ক চাচ্ছে আমেরিকা আর সৌদি আরব তাদের এই সহযোগিতা বন্ধ করুক।
২. তুরস্ক যদি নিকট ভবিষ্যতে এই YPG/PYD গ্রুপের বিরুদ্ধে সিরিয়াতে নতুন কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা কর আমেরিকার যেন সেখানে সমর্থন দেয়।
৩. সৌদি আরব যেন ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তুরস্ক মনে করে সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের সমর্থনের কারণেই ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের উপরে আক্রমণের পরিমান বাড়িয়েছে এবং আরব বিশ্বের কেউই এর বিরুদ্ধে এখন আর জোরালো ভাবে কিছু বলছে না।
৪. ইরানের উপরে চাপিয়ে দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্টের অর্থনৈতিক অবরোধ থেকে তুরস্ককে স্থায়ী ভাবে অব্যহতি দেয়া যাতে তুরস্ক ইরানের কাছ থেকে পেট্রল এবং গ্যাস আমদানি সহ সব ধরনের বাণিজ্য অবাধে করতে পারে।
লেখক: সারওয়ার আলম, ডেপুটি চিফ রিপোর্টার-নিউজ পাবলিশার, আনাদলু এজেন্সি, তুরস্ক