সালেহা। সাত মাসের পোয়াতি। ক্লান্ত বিষণ্ণ দুটো চোখ অনেক কিছু বলতে চায়, অথচ বলে না। বিহ্বলতা যেন সারা শরীর লেপ্টে আছে। লিকলিকে হাত-পা ছাপিয়ে বেঢপ সাইজের পেটটা চোখে পরে আগে। মনে হয় ওখানে জমা আছে মুক্তি অথবা আরও বেশি বঞ্চনা।
- আচ্ছা তোমার তিনটা বাচ্চা, আবার বাচ্চা নিলা যে?
- আফা যে কী কন! একটা পোলা না অইলে কি অয়? ছেলে অইল বংশের বাত্তি। মাইয়া দিয়া আশা কী? পরের বাড়ির খুঁটা। মানুষটা কয়, এত দিন কিছু কই নাই, তয় এইবার পোলা না অইলে আমার কিছু করণ থাকব না। আবার...
সালেহা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আফা আমারে যেন আল্লাহ একটা পোলা দেয়। তাইলে আমার সংসারটা টিক্কা যাইব আফা। বলেই আবার নিঃশব্দ কান্না...
আসলেই কি সংসার টিকে যায় নাকি একে সংসার বলে? আমি জানি না। আমার অস্থির লাগতে থাকে!
রোজ রোজ এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ভালো লাগে না। কেমন যেন এক দমবন্ধ গুমোট অবস্থা। তাই ভাবলাম আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি।
জানেন কী, একজন নারী কতটা পিচ্ছিল পথ পারি দেন সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে? কতটা নির্ঘুম রাত জমা হয় তার আপন ডায়েরিতে? কতটা পরিবর্তন পরিবর্জনের ভেতর দিয়ে যায় শারীরিক ও মানসিকভাবে?
সৌন্দর্যপ্রিয় মেয়েটি, যার ওজনে মারাত্মক এলার্জি, 'ওজন কেন বাড়ছে না, বাচ্চা ঠিক আছে তো?' বলে আতংকিত হয়। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, অথচ 'বাচ্চা ভালো আছে তো আপা?' বলে আবার হা করে শ্বাস নেয়! আমি অবাকের পর অবাক হই। মা কী দিয়ে তৈরি?!
অথচ সন্তান কেন মেয়ে? এই প্রশ্নে মাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় সবচেয়ে বেশি। একজন মায়ের প্রতি এ যে কত বড় অবিচার! কত জঘন্য নীচতা, বলে বোঝানো যাবে না। কিছু কিছু পুরুষ এটাকে ইস্যু করে নতুন বিয়েতে উত্তরণ খোঁজে। নতুন একসময় পুরনো হয়। আবার...
আসুন জেনে নিই,
" সন্তান ছেলে না মেয়ে?" কার দায় কতটুকু:
প্রতিটা শরীর কোটি কোটি ছোট ছোট কোষের সমন্বয়ে তৈরি। এই কোষ শরীরের একক। আবার এক একটা কোষে থাকে ৪৬টা ক্রোমোজোম। এর মধ্যে ৪৪টা অটোজোম (শরীর তৈরিকারক), ২টা সেক্স ক্রোমোজোম (লিঙ্গ নির্ধারক)।
নারীর ক্রেমোজোম ৪৬ XX এবং
পুরুষের ৪৬ XY
এখন বাচ্চাকাচ্চা আসতে হলে নারী পুরুষ উভয়ের থেকে অর্ধেক অর্ধেক সংখ্যক ক্রোমোজোম আসবে অর্থাৎ-
নারী পুরুষ
৪৬ XX( ২৩X+২৩X) ৪৬XY(২৩X+২৩Y)
বাবার ২৩ X+ মায়ের ২৩X= ৪৬XX= মেয়ে
বাবার ২৩Y+ মায়ের ২৩ X= ৪৬ XY= ছেলে
এখানে লক্ষ্য করে দেখুন, ছেলে বা মেয়ে দুটো ক্ষেত্রেই মায়ের অংশের ক্রোমোজম কিন্তু ২৩X.
সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে এটা নির্ভর করে Y ক্রোমোজোমের ওপর, আর নারীদের Y ক্রোমোজোম- ই নেই। অথচ ছেলে কেন হলো না? এই প্রশ্নবাণ তাকে সয়ে যেতে হয় পলে পলে। সামাজিক ও পারিবারিক উদ্ভট এবং অবিবেচক আচরণের শিকার হতে হয়। কখনো কখনো ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন...বাপের বাড়ি।
একটা জন্ম= একটা ডিম্বাণুর আধেক + একটা শুক্রাণুর আধেক = একটা প্রাণ। এই প্রাণ হাসবে, খেলবে, প্রেমে পরবে, বিয়ে করবে, বাচ্চা নেবে, এভাবে চলতে থাকবে...চলতেই থাকবে... সব প্রোগ্রাম করা। শুরু কবে হয়েছিল, জানি না, শেষ কবে হবে, তাও জানি না।
এই না জানার বাইরে একচুলও যাওয়ার উপায় নেই। তবে কেন এত অনাচার? নারী তো সয়ে যায়, সৃষ্টিকর্তা সইবে তো!
এবার একটা গল্প দিয়ে শেষ করছি-
এক দম্পতি, টম এবং জেরী টাইপ। তাহাদের দুই পুত্রসন্তান। একদিন বর (টম) আবিষ্কার করল, তারা নানা-নানি হতে পারবে না, কারণ তাদের মেয়ে নাই। দুঃখ!
তারা মেয়ের মিশনে যেতে চায়। তবে জেরীর শর্ত একটাই, মিশনে যেতে আপত্তি নেই, তবে তার মেয়েই চাই। কত দিনের স্বপ্ন! টলমল পায়ে ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট এক মেঘ বালিকার!
টমকে বলে, 'এবার যদি আমাদের মেয়ে না হয়, তাইলে কিন্তু তোমার খবর আছে! আমি তোমার সঙ্গে সংসার করব না।'
এখানে জেরী সব বঞ্চিত নারীর হয়ে কথাটা বলল, যা এত দিন পুরুষরা সন্তান ছেলে না হলে, অন্যায়ভাবে নারীকে বলে আসছে।
টম দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। একটা লাল ফ্রক পরা মেয়ে তার চোখের বারান্দায় ঝুলে ঝুলে দোল খায়, কিন্তু সে মুখে বলে, 'কী দরকার মেয়েতে? সন্তান তো সন্তানই। ছেলেই কী, মেয়েই কী?'
ইশ! সব স্বামীরা যদি টমের মতো হতো, তাহলে সালেহাদের জীবনটা কতই না সুখে কাটত।
'অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে... ' টম এবং জেরী গল্পের সমাপ্তিতে থাকলে ও মানুষের জীবনে থাকে না। আফসোস, মানুষের জীবনটা কেন গল্পের মতো হয় না?
লেখক: ডা. ছাবিকুন নাহার, মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল