বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল, ১৪৪৫ | ০১:১৬ অপরাহ্ন (GMT)
ব্রেকিং নিউজ :
X
শিরোনাম :
  • নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে আ.লীগ: কাদের
  • ইসি নয়, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে হার্ডলাইনে যাবে বিএনপি


রোববার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ ০৪:৫৯:৪৮ পূর্বাহ্ন Zoom In Zoom Out No icon

বাসচালক-হেলপারদের ধর্ষণ যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারীরা

আশঙ্কাজনক হারে সারা দেশে বাসচালক, হেলপার ও তাদের সহযোগীদের হাতে গণধর্ষণ, ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সারা দেশে গত ১৩ মাসে গণপরিবহনে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ তবে প্রকৃত অবস্থা আরও খারাপ বলে মনে করছেন তারা৷ খবর ডেয়েচে ভেলের। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর পর্যবেক্ষণ করে যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, গত ১৩ মাসে বাসচালক-হেলপার ও তাদের সহযোগীরা ৯টি সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ৮টি ধর্ষণ ও ৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটিয়েছে৷ এসব ঘটনায় ৫৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে৷ এর মধ্যে গত বছরের ৯ এপ্রিল মানিকগঞ্জে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি৷ যাত্রীকল্যাণ সমিতি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণও দিয়েছে৷ গত ২১ জানুয়ারি রাজধানীর দারুসসালামে চলন্ত বাসে যৌন হয়রানির অভিযোগে গাবতলী-নবিনগর রুটের বাসচালক ও হেলপারের বিরুদ্ধে দারুসসালাম থানায় মামলা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী৷ এ ঘটনায় পুলিশ চালক ও হেলপারকে আটক করেছে৷ ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ ইজিবাইকে করে চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে আলমডাঙ্গায় ফিরছিলেন এক স্কুলছাত্রী৷ ইজিবাইকের ভাড়া মেটাতে না পারার অজুহাতে চালকসহ চারজনের ধর্ষণের শিকার হন ওই স্কুলছাত্রী৷ গত বছরেরই ৯ এপ্রিল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এসআই পরিবহনের চলন্ত বাসে স্বামীর সামনে এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ ৩১ জুলাই কুড়িগ্রামের রৌমারীতে পদ্মা পরিবহনের একটি বাসে ঢাকা আসার পথে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় এক কিশোরী গৃহকর্মী৷ এক মাস পর অর্থাৎ গত আগস্টে গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে ট্রাকচালক মেহেদী হাসান ও হেলপার সোহান মিলে এক কিশোরীকে চলন্ত ট্রাকে ধর্ষণ করে৷ পরে পুলিশ ট্রাকের চালককে আটক করে৷ আগস্টেই রাজধানীর বনানীতে এক তরুণীকে প্রাইভেটকারে তুলে নিয়ে যৌন হয়রানির চেষ্টা চালায় ইমরান হোসেন নামে এক ব্যক্তি৷ এই ঘটনায় ইমরানকে গ্রেফতার ও গাড়িটি জব্দ করে পুলিশ৷ আগস্টেরই আরেক ঘটনা৷ ১১ আগস্ট ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় লেগুনার চালক জয়নাল আবেদিন ও হেলপার রিপন ওই এলাকার ৭ম শ্রেণির এক মাদ্রাসাছাত্রীকে ধর্ষণ করে৷ ছাত্রীর চাচা বাদী হয়ে মামলা করলে পুলিশ চালক ও হেলপারকে আটক করে৷ দুই সপ্তাহের মধ্যেই ঘটে ধর্ষণের আরেকটি ঘটনা৷ ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় চলন্তবাসে জাকিয়া সুলতানা রুপা নামে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷ এরপর ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে লোহাগাড়া যাওয়ার পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বাসে এক গৃহবধুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে বাসের চালক জনি বডুয়া ও হেলপার মো. এহসানকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বছরের কারাদণ্ড দেন৷ ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত থেকে বহদ্দারহাটে যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে চালক রাশেদুল ইসলাম ও সহকারী ইমতিয়াজ উদ্দীন এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে৷ তরুণী থানায় মামলা করলে পুলিশ ওই দুজনকে আটক করে৷ ৩ নভেম্বর গাজীপুর বাইমাইল এলাকায় নৌকায় তুলে এক পোশাক শ্রমিককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে চার দুর্বৃত্ত৷ ২১ ডিসেম্বর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আনন্দ পরিবহনের বাসে ৮ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে বাসচালক পারভেজ৷ এর আগে গত বছরের ২২ জানুয়ারি কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে নদীয়ার রেলস্টেশনে বাংলাদেশি এক নারী যাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হন৷ গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীতে বাসের ভেতরে এক নারীকে যৌন হয়রানি করে বাসচালক ইসমাইল হোসেন ও তার চার সহযোগী৷ ওই বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ভালুকায় বাসে আটকে রেখে ১৩ বছরের এক কিশোরী পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে বাসের হেলপার হাফিজুল ইসলাম৷ এ ছাড়া ২১ মে কুড়িল বিশ্বরুটে মাইক্রোবাসে এক গারো তরুণী ধর্ষণের শিকার হন৷ ১৩ মে ময়মনসিংহের চুলখাই এলাকায় বাসচালক ও হেলপার মিলে ধর্ষণ করে এক তরুণীকে৷ ১১ মে ঢাকার অদূরে সোনারগাঁওয়ে বাসের মধ্যে এক তরুণীকে ধর্ষণ করে বাসচালক ও তার সহযোগী, ৩ মে আশুলিয়ার বাস কাউন্টার থেকে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ ওই তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷ ২৫ এপ্রিল খিলগাঁওয়ে এক গৃহবধূকে মাইক্রোবাসে যৌন নির্যাতনের পর ওই মাইক্রোবাসে চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়৷ ১৯ এপ্রিল ঢাকা থেকে জামালপুরগামী ট্রেনে দুর্বৃত্তদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হন এক নারী৷ যাত্রী কল্যান সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমরা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথের ভিত্তিতে এই তথ্য প্রকাশ করেছি৷ আর এসব ঘটনায় পুলিশ সক্রিয় হয়েছে৷ অভিযোগ বা মামলাও করা হয়েছে৷ কিন্তু আমরা মনে করি, এটি প্রকৃত ঘটনা যা ঘটে তার চেয়ে অনেক কম৷ কারণ সব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয় না৷ আবার সবাই নানা কারণে পুলিশের কাছে অভিযোগও করেন না। তিনি বলেন, সাধারণত গণপরিবহনের নারী যাত্রীরা নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত৷ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত নারীরা গণপরিবহণ ব্যবহার তেমন করেন না৷ তাই গণপরিবহণে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না৷ তিনি আরও বলেন, সমস্যা হচ্ছে- পরিবহনে কোনো নারী যৌন হয়রানির শিকার হলে তিনি কোথায় অভিযোগ করবেন ঠিক বুঝে ওঠতে পারেন না৷ এ জন্য মোবাইল কোর্ট সক্রিয় করা উচিত৷ রুট অনুযায়ী, মোবাইল কোর্টের ফোন নাম্বার গণপরিবহনের প্রকাশ্য স্থানে লিখে রাখতে হবে৷ আর মালিকদের উচিত হবে বাসের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া, মোটিভেশন প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করা৷ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নারীদের জন্য আলাদা বাস, যেখানে ড্রাইভার, হেলপার সব নারী হবে- এটি একটি সমাধান হতে পারে৷ কিন্তু এটি হয়তো ঢাকায় হতে পারে, সারা দেশে সম্ভব নয়৷ আর তাতে বাস থেকে নামার পর তাদের নিরাপত্তা দেবে কে? তাই সার্বিকভাবে নারীদের নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি৷ সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে৷ টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে রূপা হত্যা এবং ধর্ষণ মামলার রায়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি চারজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ একজনকে দেয়া হয়েছে সাত বছরের কারাদণ্ড৷ গত বছরের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে কর্মস্থল ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে জাকিয়া সুলতানা রূপা পরিবহন শ্রমিকদের সংঘদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন৷ বাসেই হত্যার পর মধুপুর উপজেলায় পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে রুপার মরদেহ ফেলে দেয়া হয়েছিল৷ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এবং মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, রূপা হত্যা এবং ধর্ষণের বিচার হয়েছে৷ এটা হয়তো আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে৷ কিন্তু গণপরিবহণে তাতে যৌন হয়রানি কমবে বলে মনে হয় না৷ আমরা এই ধরনের যৌন হয়রানির প্রচুর অভিযোগ পাই৷ আসলে অভিযোগ জানানোর বিষয়টি সহজ করতে হবে৷ কারণ, চলন্ত বাসে ঘটনা কোন থানা এলাকায় তা নিয়ে পুলিশের আইনি দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত অনেক ঘটনায়ই আর অভিযোগ হয় না৷ তাই এইসব ব্যাপারে তাৎক্ষণিক অভিযোগ নেয়ার কোনো একক ব্যবস্থা চালু করতে হবে৷ তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, নারীদের জন্য নারী ড্রাইভার ও হেলপার দিয়ে যদি পর্যাপ্তসংখ্যক বাস নামানো যায়, তা হলে হয়তো কিছুটা সমাধান আশা করা যায়৷ কিন্তু তার পরও সমস্যা থেকে যাবে৷ অভিযোগ দায়ের এবং অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হলে আমি মনে করি, এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে৷ আর বাসে নারীদের যে আসন সংরক্ষণের বিধান আছে, তা সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে৷





আরো খবর