একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের চলমান সংলাপে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা।
গত রবিবার মির্জা ফখরুলের ১৭ সদস্যের বিএনপির প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নিতে গেলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে গোটা জাতি। কেননা, দলটি অনেক বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। তাদের দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
তিনি এও বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা গঠন ও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা চালু করে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করে বিএনপি।
অন্যদিকে বুধবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে দলের ২১ সদস্যের প্রতিনিধি দল সংলাপে নির্বাচন কমিশনের কাছে সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি চালুসহ ১১টি প্রস্তাব তুলে ধরে।
প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নিতে গেলে প্রধান নির্বাচন কমিশন একই প্রক্রিয়ায় তাদেরও ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা বলেন, আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিয়েছে আর তাদের সরকারের আমলেই নির্বাচন কমিশনের অধিকাংশ আইন কানুন করা তাই তাদের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরামর্শ চায় নির্বাচন কমিশন।
সিইসি বলেন, সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে এবং বেশ কয়েকজনের রায়ও কার্যকর করেছে। আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নযনের মহাসড়কে তুলে দিয়েছে। শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির প্রসার অবকাঠানোর উন্নয়ন এবং প্রকৃতি সংরক্ষণে আজ ধরিত্রীর বিশ্ব মুকুট শেখ হাসিনার মাথায়।প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়ে বা উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।
এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদার মুখে বিএনপির প্রশংসার প্রেক্ষিতের সাংবাদিকের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা বলেছেন কি না সেটা নিশ্চিত হতে হবে,বলে থাকলে সেটি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কৌশল হতে পারে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার জিয়াউর রহমান নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তা কোনো সংবাদ সম্মেলনে বলেননি। তিনি নির্বাচন কমিশনের ভেতরে বলেছেন। ফলে তিনি কী বলেছেন তা নিশ্চিত হতে হবে। আগামী ১৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক আছে। সেখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ হবে।
এরপর বুধবার সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির ভূয়সী প্রশংসার ব্যাখ্যা আমরা পেয়েছি- এটা বলতে চাই না। যদি কোনো ব্যাখ্যা দিতে হয় তা নির্বাচন কমিশন দেবে।
তিনি বলেন, তবে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সচিবদের প্রত্যেকের যে বক্তব্য এটি আমরা মনে করি ইউজফুল পজেটিভ ডায়ালগ।’
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা’ ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বিষয়ে দলটির সঙ্গে ইসির নির্বাচনী সংলাপে সিইসি যে প্রশংসা করেছেন একে ‘রাজনৈতিক ইতিবাচকতা’ হিসেবেই দেখছেন একই সঙ্গে আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কমিশনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আজকের সংলাপ ‘কনস্ট্রাকটিভ’ হয়েছে বলেও জানান তিনি।
কমিশনে পেশকৃত দলের প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে ইসির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে কাদের বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনাররা ‘ইন ওয়ান ভয়েস’-এ প্রত্যেকে বলেছেন, আমাদের এই প্রস্তাবগুলো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রস্তাব বলে তাদের কাছে মনে হয়নি। কমিশন বলেছে- অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও এক্সেপ্টেবল নির্বাচনের স্বার্থে যে প্রস্তাবগুলো দেয়া প্রয়োজন আপনাদের কাছ থেকে তা পেয়েছি। এগুলো অত্যন্ত পজেটিভ প্রস্তাব।’
এদিকে এ প্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা নিরপেক্ষ নয় বলে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম।
গত সোমবার নির্বাচন কমিশনের সংলাপ বর্জন করে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে রবিবার বিএনপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সংলাপে সিইসি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় তাকে পদত্যাগ করতে হবে।
কদের সিদ্দিকী বলেন, জিয়াউর যদি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হয় বঙ্গবন্ধু কি? কে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে? সিইসি বিএনপির সংলাপে যে কথা বলেছে এটি প্রত্যাহার না করলে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। আমরা এ সিইসির পদত্যাগ চাই।
যদিও গত বছরের আগস্টে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন দেশে গণতন্ত্র পুনঃরুদ্ধারে নতুন পরামর্শ দেন।
অন্যদিকে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার, ইভিএম পদ্ধতি চালু না করাসহ ২০ দফা দাবি পেশ করে। বিএনপি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) আমাদের দেওয়া ২০ দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করবে বলে আশ্বস্ত করেছেন। ফলে আমরা কিছুটা আশাবাদি।
এদিকে সংলাপে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সংলাপে নির্বাচন কমিশনের কাছে দেয়া প্রস্তাবনাসমূহ পরস্পরে প্রত্যখ্যান করেছে।
বুধবার বিকেলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশনকে দেয়া আওয়ামী লীগের ১১ দফা প্রস্তাবই সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় অন্তরায়।
ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের ভাষা বুঝতে পারছে না। জনগণ পরিবর্তন চায়, ভোটের অধিকার চায়। দলীয় সরকারের অধীনে জনগণ ভোটের অধিকার পাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ফের জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
অন্যদিকে সংবিধানের বাহিরে অবাস্তব অবান্তর প্রস্তাব দিয়ে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত না করতে বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ।
তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচন কমিশনকে গ্রহণ করে সংলাপে অংশগ্রহণ করেছে ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতা নিয়েও বিএনপি প্রশ্ন তুলেছিল। বিএনপি নির্বাচন কমিশনে সংলাপে অংশগ্রহণ করায় সাধুবাদ জানাই, ধন্যবাদ জানাই। আমরা আশা করি তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।’
এছাড়া সরকারী জোটের শরীক দল জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, নির্বাচনি রোডব্লক করতেই নির্বাচন কমিশনের কাছে এখতিয়ার বহির্ভূত এবং সংবিধান পরিপন্থী ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।নির্বাচন বানচাল করাই তাদের উদ্দেশ্য।
তিনি বলেন বিএনপির অনেকগুলো অযৌক্তিক-অস্বাভাবিক প্রস্তাবের পাহাড়। বেশির ভাগ প্রস্তাব আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) পরিপন্থী ও নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে।’ সশস্ত্র বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে বিএনপির প্রস্তাব অযৌক্তিক প্রস্তাব।
ফলে চলমান সংলাপ নিয়ে জনমনেও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আসলে কী নির্বাচন কমিশনের এই সংলাপ সফল হবে? তারা কী পারবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে? এছাড়াও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মুখে প্রধান দুই দলের ভূয়সী প্রশংসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এই প্রশংসার নেপথ্যে কী কারণ, তা নিয়েও ভাবনা শুরু হয়েছে।
এক. উভয়পক্ষের ভূয়সী প্রশংসা করে সবার আস্থা অর্জন করা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এক ধরনের কৌশল হতে পারে। যেটা সঙ্গত কারণেই সবার কাছে কাম্য।
দুই. অনেকে বলছেন, এর মাধ্যমে বিএনপিকে বশে আনার কুট কৌশল হতে পারে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের। কেননা,প্রথম থেকেই বিএনপি তার প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে আসছে।
তিন. বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কৌশল হতে পারে। যা বলেছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তাদের সঙ্গে সংলাপের পর তিনি এও বলেছেন, বিএনপির ভূয়সী প্রশংসার ব্যাখ্যা আমরা পেয়েছি- এটা বলতে চাই না। ফলে বিএনপির কোনো কোনো নেতার মনেও নিয়ে এক ধরনের সন্দেহ কাজ করছে।
চার. দলীয় গণ্ডির বাইরের অনেকেই মনে করেন, প্রধান নির্বাচন কমিশারের এই কৌশল যুক্তিসঙ্গত যদি তিনি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারেন। তবে সেটা পুরোটাই নির্ভর করছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মানসিকতা ও সাহসের ওপর।
সবশেষে বলবো, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার এটা কৌশল, না কুট কৌশল তা দেখতে আমাদেরকে একাদশ নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সত্যিই যদি তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করেও একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারেন তাহলে তার নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যথা, গোটা জাতিকে এর জন্য মাশুল গুনতে হবে আরো বহুকাল। শুধু তাই নয়,নিজেও নিক্ষিপ্ত হবেন জনমনের ঘৃর্ণার পাত্রে। এখন আমাদেরকে আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে, দেখতে হবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা সাহসী ভূমিকা নিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় লিখাতে পারেন কিনা, না জাতীয় বিশ্বাসঘাতকের পাতায় আরেকটি নাম নতুনভাবে সংযোজন করেন।জাতির প্রত্যাশা তিনি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবেন।